RSS: সঙ্ঘের শিবিরগুলিতে কী শেখানো হয়? গান্ধী থেকে অম্বেডকর কী ভাবতেন আরএসএস সম্পর্কে?

জাতপাতহীন সমাজব্যবস্থার প্রতিফলন দেখা যায় আরএসএস-এর প্রশিক্ষণ শিবিরগুলিতে...
RSS-1
RSS-1

মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: সারা বছর ধরেই নানা কার্যক্রমের আয়োজন করে থাকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (RSS)। এর পাশাপাশি সংগঠনকে শক্তিশালী করতে এবং কর্মীদের শারীরিক এবং বৌদ্ধিক বিকাশের লক্ষ্যে সঙ্ঘের তরফে আয়োজন করা হয় প্রশিক্ষণ শিবিরেরও। এই প্রশিক্ষণ শিবিরগুলি সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গ নামেই পরিচিত। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রশিক্ষণ শিবির রয়েছে তিনটি স্তরে। এই তিনটি স্তর হল, সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গ-প্রথম বর্ষ, সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গ-দ্বিতীয় বর্ষ, সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গ-তৃতীয় বর্ষ। প্রতিটি প্রশিক্ষণ শিবিরই চলে দুই থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত।

শিবিরগুলিতে নিত্য প্রয়োজন সামগ্রী সমেত স্বয়ংসেবকরা হাজির হন

শিবিরগুলিতে নিত্য প্রয়োজন সামগ্রী সমেত স্বয়ংসেবকরা (RSS) হাজির হন। তবে প্রত্যেকেই যে এই শিবিরগুলিতে অংশগ্রহণ করতে পারেন, এমনটা নয়। সারা বছর ধরে শাখার মাধ্যমে বাছাই করা স্বয়ংসেবকদের প্রশিক্ষণ শিবিরে অংশগ্রহণ করানো হয়। প্রতিটি শিবিরে স্বয়ংসেবকদের ভোর চারটে নাগাদ উঠতে হয়। শিবির চলে রাত্রি দশটা পর্যন্ত। সকাল এবং সন্ধ্যা এই দুটি সময় রাখা হয় শারীরিক অনুশীলনের জন্য। এর পাশাপাশি বিকাল এবং সন্ধ্যার পরের সময়টিকে ব্যবহার করা হয় নানা রকমের বৌদ্ধিক আলোচনার জন্য। বৌদ্ধিক আলোচনায় দেশ-কাল-সমাজের বিভিন্ন ইস্যু, ইতিহাস যেমন থাকে তেমনই দেশ গঠনের স্বয়ংসেবকদের (RSS) ভূমিকা কী হতে পারে, সেটাও থাকে। এর পাশাপাশি দেশের সভ্যতা এবং সনাতন সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছেন এমন মহাপুরুষদের জীবনী বিষয়ক পাঠও দেওয়া হয় স্বয়ংসেবকদের। পাঠ দেওয়া হয় ভারতের সুমহান প্রাচীন ঐতিহ্য, দেশের প্রাচীন সংস্কৃতির বিষয়েও।

স্বয়ংসেবকদের একটি দল থাকে ভোজন ব্যবস্থার দায়িত্বে

সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গে স্বয়ংসেবকদের (RSS) ডায়েট মেনেই চলতে হয়। তাঁদেরকে নিরামিষ ভোজন পরিবেশন করা হয়। কম তেল-মশলাযুক্ত খাবার স্বয়ংসেবকদের পাতে দেওয়া হয়। এই খাবার রান্নার জন্য আলাদা করে কোনও রাঁধুনি থাকে না। বরং স্বয়ংসেবকদের মধ্যে থেকেই একটি দল ভোজন ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকে। প্রতিদিন শিবিরগুলিতে কী কী হবে, তার দৈনন্দিন রুটিন শিবির চালুর আগে থেকেই স্বয়ংসেবকদের হাতে পৌঁছে যায়। স্বয়ংসেবকরা শিবির শেষে রাত্রিতে যখন ঘুমাতে যান তখন একটি হলঘরে একসঙ্গে তাঁদেরকে ঘুমাতে হয়। সাধারণভাবে যেকোনও প্রতিষ্ঠান ভাড়া করেই এমন শিবিরগুলির আয়োজন করে তাকে আরএসএস। সারি দিয়ে বিছানা তৈরি করা থাকে। বিছানার চাদর থেকে আরম্ভ করে শোবার সামগ্রী স্বয়ংসেবকদের আনতে হয়।

কারা হতে পারেন প্রচারক

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (RSS) প্রথম এবং দ্বিতীয় বর্ষের ট্রেনিং ক্যাম্পগুলি প্রাদেশিক এবং জেলা স্তরে অনুষ্ঠিত হয়। তবে তৃতীয় বর্ষের ট্রেনিং ক্যাম্প একেবারে সঙ্ঘের সদর কার্যালয় নাগপুরেই অনুষ্ঠিত হয়। তৃতীয় বর্ষের ট্রেনিং ক্যাম্পে কারা অংশগ্রহণ করবেন, তার বাছাই পর্ব চলে সারা দেশ জুড়ে। এই প্রশিক্ষণ পর্ব ৩০ দিনের হয়ে থাকে। সাধারণভাবে প্রতিবছর গ্রীষ্মকালের মে জুন মাসেই তৃতীয় বর্ষের প্রশিক্ষণ শিবির অনুষ্ঠিত হয় নাগপুরে। প্রথম এবং দ্বিতীয় বর্ষের প্রশিক্ষণ পর্ব শেষ করেছেন এমন স্বয়ংসেবকরাই যোগ্য হন তৃতীয় বর্ষের ট্রেনিং ক্যাম্পে অংশগ্রহণের বিষয়ে। সাধারণভাবে ১৬ বছরের উর্ধ্বে যে কোন যুবকই প্রথম এবং দ্বিতীয় বর্ষের প্রশিক্ষণ পর্বে অংশগ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু তৃতীয় বর্ষের প্রশিক্ষণ পর্বে অংশগ্রহণ করতে গেলে ন্যূনতম বয়স লাগে ১৮ বছর। তৃতীয় বর্ষ প্রশিক্ষণ পর্ব সমাপ্ত হওয়ার পরে যে সমস্ত স্বয়ংসেবক আজীবন ব্রহ্মচর্য ব্রত পালনে রাজি থাকেন এবং দেশের জন্য কাজ করব এই মানসিকতা স্থির করেন, পূর্ণ সময়ের জন্য তাঁরা প্রচারক হিসেবে হন।

১৯২৯ সালে নাগপুরে হয়েছিল প্রথম শিবির

সঙ্ঘের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে তাদের প্রথম প্রশিক্ষণ পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৯ সালে নাগপুরে (RSS)। ৪০ দিনের এই প্রশিক্ষণ শিবির চলেছিল ১ মে থেকে ১০ জুন পর্যন্ত। তখন এই শিবিরের নাম সঙ্ঘ প্রশিক্ষণ বর্গ ছিল না বরং তা গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্প নামেই পরিচিত ছিল। ১৯৫০ সালের পর থেকে সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গ-এই শব্দ চালু হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে সঙ্ঘের প্রশিক্ষণ পর্বের ধরনেরও। প্রথমদিকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রশিক্ষণ শিবিরগুলিতে বিভিন্ন সামরিক ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো এবং প্রশিক্ষণের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হত ইংরেজি।

ক্যাম্পের নামকরণের ইতিহাস 

বিএন বারাদপান্ডে ছিলেন নাগপুরের একজন আরএসএস কার্যকর্তা। তিনি একটি বই লিখেছিলেন 'সঙ্ঘ কার্যপদ্ধতি কা বিকাশ'। ওই বইতে তিনি লিখছেন, ‘‘একটি বৈঠকে (RSS) আমরা আলোচনা করছিলাম যে কিভাবে আমরা গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পকে সম্বোধন করব। কেউ একজন প্রস্তাব দিয়েছিলেন এটার নাম হওয়া উচিত 'ট্রেনিং ক্লাসেস'। অন্য একজন স্বয়ংসেবক বলেন, ক্যাম্প হল আরএসএস-এর শাখারই বিস্তৃত রূপ তাই আমাদের এটা বলা উচিত 'সঙ্ঘ ট্রেনিং ক্লাস'। কিন্তু ডাক্তার কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার বলেন,  এই ক্যাম্পগুলি চালানো হয় সেই সমস্ত কর্মীদের জন্য, যাঁরা সংগঠনকে সর্বোচ্চ সময় দেবেন। তাই এই ক্যাম্পের নাম হওয়া উচিত অফিসার্স ট্রেনিং ক্যাম্প বা ওটিসি।’’ প্রসঙ্গত, আজও ওটিসি সঙ্ঘের সংগঠনের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় শব্দ হয়ে রয়েছে। যদিও এই নামে এখন আর কোনও ক্যাম্প নেই। গুরুজি গোলওয়ালকর এই ক্যাম্পের নামকরণ করেন সঙ্ঘ শিক্ষা বর্গ।

প্রথম দিকের শিবিরগুলি কোথায় অনুষ্ঠিত হত

জানা যায়, ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত বেশ কিছু বিনোদনমূলক কার্যক্রমও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (RSS) ক্যাম্পগুলিতে আয়োজিত হত। এগুলি হত শনিবার সন্ধ্যায় এবং রবিবারে। কিন্তু ১৯৩৮ সাল থেকেই তা পাল্টে যায় কারন সেই বছর থেকেই সঙ্ঘের প্রশিক্ষণ শিবিরের সময়সীমা ৪০ থেকে কমিয়ে ৩০ দিন করা হয়। ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রশিক্ষণ শিবির অনুষ্ঠিত হতো নাগপুরে। অন্যদিকে, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বর্ষের প্রশিক্ষণ শিবিরগুলি পুনেতে শুরু হয় ১৯৩৫ সাল থেকে। ১৯৩৮ সাল থেকে প্রথম এবং দ্বিতীয় বর্ষের ক্যাম্পগুলি চালু করা হয় লাহোরে।

জাতপাতহীন শিবির

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (RSS) প্রশিক্ষণ শিবর গুলিতে জাতপাতহীন সমাজ ব্যবস্থার প্রতিফলন দেখা যায়। যাঁরা অংশগ্রহণ করেন শিবিরে, তাঁরা নিজেদেরকে সামাজিক দিক থেকে একই রকম ভাবেন। তাঁদের মধ্যে কোনও ভেদাভেদ কাজ করে না। সঙ্ঘের প্রশিক্ষণ শিবিরগুলিতে যাঁরা প্রশিক্ষণ দেন এবং যাঁরা প্রশিক্ষণ নেন, প্রত্যেকের মধ্যেই ভ্রাতৃত্ববোধ কাজ করে। তাঁরা একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করেন। একসঙ্গে চলাফেরা করেন।

মহাত্মা গান্ধীর চোখে সঙ্ঘের শিবির

১৯৩৪ সালে মহাত্মা গান্ধী ওয়ার্ধাতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের শিবির পরিদর্শন করেন এবং স্বয়ংসেবকদের উদ্দেশ্যে তিনি বক্তব্য রাখেন। পরবর্তীকালে শিবির পরিদর্শনের কথা মহত্মা গান্ধীর বলেন ১৯৪৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে। তিনি বলেন, ‘‘আমি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের শিবির পরিদর্শন করেছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে। যখন ডাক্তার কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার জীবিত ছিলেন। আমি খুবই আশ্চর্য হয়েছিলাম সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকদের এমন নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা পরায়ণতা এবং জাতপাতহীন সমাজ ব্যবস্থা দেখে। তারপর থেকে সঙ্ঘের অনেকটা বিকাশ হয়েছে। আমি নিশ্চিত যে সংগঠনে এমন মহান আদর্শ এবং আত্মত্যাগের মন্ত্র রয়েছে তারা শক্তিশালী হবেই।’’

বাবা সাহেব অম্বেডকরের চোখে সঙ্ঘের শিবির

বাবা সাহেব অম্বেডকর সঙ্ঘের শিবির পরিদর্শন করেন ১৯৪৯ সালে পুনেতে। বাবাসাহেব অম্বেডকর ডাক্তার কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারকে জিজ্ঞাসা করেন যে সঙ্ঘের শিবির গুলিতে অস্পৃশ্যতা সংক্রান্ত অসুবিধা রয়েছে নাকি! তখন আরএসএস প্রতিষ্ঠাতা তাঁকে উত্তর দেন, এখানে কোনও অস্পৃশ্যতা নেই। যাঁরা এখানে আসেন তাঁরা প্রত্যেকেই শুধু হিন্দু। প্রত্যুত্তরে অম্বেডকর বলেন, আমি এই শিবির পরিদর্শন করে আশ্চর্য হলাম। স্বয়ংসেবকরা অন্যদের জাতপাত না জেনেও তাঁদের সঙ্গে ভ্রাতৃত্ববোধ নিয়ে চলাফেরা করেন। বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী জয়প্রকাশ নারায়ণ যিনি সোসালিস্ট ছিলেন এবং সত্তরের দশকে ঐতিহাসিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী সরকারের বিরুদ্ধে, তিনিও ১৯৭৭ সালের ৩ নভেম্বর পাটনাতে আরএসএস-এর (RSS) ট্রেনিং ক্যাম্পে সম্মোধন করেন। ২০১৮ সালের জুন মাসে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও সঙ্ঘের তৃতীয় বর্ষের ট্রেনিং ক্যাম্পে সম্বোধন করেন।

 

দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের  Whatsapp, FacebookTwitter, Telegram এবং Google News পেজ।

Share:

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn

You may also like

+ There are no comments

Add yours

Recent Articles