Gopinath Temple: ফি বছর ভক্তের শ্রাদ্ধের কাজ করতে মর্ত্যে নেমে আসেন ভগবান!

Agradwip: শ্রীচৈতন্যের আদেশেই অগ্রদ্বীপে তৈরি হয় গোপীনাথ মন্দির....
Gopinath_Temple
Gopinath_Temple

হরিহর ঘোষাল

ফি বছর ভগবান স্বয়ং ভক্তের শ্রাদ্ধ করতে মর্ত্যে নেমে আসেন! গল্প বলে মনে হলেও এটাই সত্যি। পূর্ব বর্ধমানের অগ্রদ্বীপের (Agradwip) বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মানুষদের এটাই বিশ্বাস। আর সেই বিশ্বাস থেকেই প্রায় ৫০০ বছর ধরে প্রতি বছরই নির্দিষ্ট তিথি মেনে অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ মন্দিরে (Gopinath Temple) দিনটি পালন করা হয়। আর পবিত্র সেই দিন ভগবান দর্শনে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিড় করেন অগ্রদ্বীপে।

শ্রীচৈতন্যের আদেশে তৈরি গোপীনাথ মন্দির (Gopinath Mandir)

পূর্ব বর্ধমানের অগ্রদ্বীপ গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের একটি তীর্থস্থান। অগ্রদ্বীপে ষোষঠাকুর নামে শ্রীচৈতন্যের একজন কায়স্থ শিষ্য বাস করতেন। কথিত আছে, সন্ন্যাস গ্রহণের পাঁচ বছর পর বৃন্দাবন যাচ্ছিলেন শ্রীচৈতন্য। পথে হরিতকি সঞ্চয় করে রাখার জন্য সঙ্গী গোবিন্দকে ত্যাগ করলেন মহাপ্রভু (বৈষ্ণবদের কিছু সঞ্চয় করতে নেই বলে)। ফলে, গোবিন্দ ঘোষ বৃন্দাবনে যেতে না পেরে অগ্রদ্বীপে থেকে যান। এই গোবিন্দ ঘোষই ঘোষঠাকুর নামে পরিচিত লাভ করেন। গঙ্গাস্নানের সময় গোবিন্দ ঘোষ একখণ্ড কালো পাথর পেয়েছিলেন। চৈতন্যদেব বৃন্দাবন থেকে ফিরে এলে তাঁরই আদেশে ওই কালো পাথর থেকে গোপীনাথের (Gopinath Temple) মূর্তি তৈরি করা হয়েছিল এবং গোপীনাথকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। আরও আশ্চর্য ব্যাপার হল, গোপীনাথ নাকি ঘোষঠাকুরকে পিতৃবৎ ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন। অনেকে মনে করেন, গঙ্গায় ভেসে আসা একটি পাথর দিয়ে গোপীনাথের বিগ্রহ তৈরি করেন এক ভাস্কর। অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ মন্দিরে (Gopinath Temple) সেই বিগ্রহ স্থাপন করেন স্বয়ং মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেব। এরপর তাঁর পার্ষদ গোবিন্দ ঘোষকে সেই গোপীনাথের ভজন-পূজনের দায়িত্ব দেন তিনি।

ভক্তের শ্রাদ্ধের কাজ ভগবান কীভাবে করেন?

ভক্তের শ্রাদ্ধের কাজ ভগবান কীভাবে করেন? এই প্রশ্ন সকলের মনেই জাগে। সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে ৫০০ বছরেরও বেশি সময় আগে। অগ্রদ্বীপ তখন গণ্ডগ্রাম। পাশ দিয়ে বয়ে চলা ভাগীরথী বর্তমানের তুলনায় দ্বিগুণ স্রোতস্বিনী। অনেকে মনে করেন, ১৫৮৮ সালে চৈত্রের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিতে মারা গিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যের একনিষ্ঠ ভক্ত এবং তাঁর অষ্ট পার্ষদের অন্যতম গোবিন্দ ঘোষ। তিনি ছিলেন গোপীনাথের (Gopinath Temple) সেবক। সেই তিথিকে স্মরণে রাখতে ফি-বছরই এই তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় গোবিন্দ ঘোষের পারলৌকিক বা চিড়ে মহোৎসব। স্বয়ং গোপীনাথ এক মাস ধরে হবিষ্যান্ন গ্রহণ করেন এবং শ্রাদ্ধকালীন কাছা ধারণ করেন। গোবিন্দ ঘোষের পারলৌকিক ক্রিয়ায় পিণ্ডদানের জন্যই এই আয়োজন। কেন এমন প্রথা? জনশ্রুতি আছে, শিশুপুত্রের মৃত্যুর পরে শোকে পাগলের মতো অবস্থা হয়েছিল গোবিন্দ ঘোষের। সেই সময় গোপীনাথ তাঁকে স্বপ্নে দেখা দেন। তিনিই পুত্র হিসেবে গোবিন্দ ঘোষের শ্রাদ্ধ করবেন বলে তাঁকে আশ্বাস দেন। সেই কথা মেনে গোবিন্দ ঘোষের মৃত্যুর পরে তাঁর শ্রাদ্ধ করেন গোপীনাথ। অনেকে বলেন, একমাত্র এখানেই ভক্তের শ্রাদ্ধ করেন ভগবান। সেই প্রথা এখনও চলছে।

গোপীনাথ কী করে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের জমিদারিভুক্ত হল?

গোপীনাথ (Gopinath Temple) কী করে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সম্পত্তি হল, সে এক ইতিহাস। আগে অগ্রদ্বীপ পাটুলির জমিদারদের সম্পত্তি ছিল। একবার অগ্রদ্বীপের বিশাল বারুণী মেলায় কিছু লোকের প্রাণহানি হয়। মুর্শিদাবাদের নবাব এই ঘটনায় ক্রুদ্ধ হয়ে সেখানকার জমিদারকে শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নবাব ডেকে পাঠালেন অগ্রদ্বীপ এলাকার আশপাশের সব জমিদারদের। দরবারে সব জমিদারদের মোক্তাররা হাজির হলেন। তাঁরা বললেন, "অগ্রদ্বীপ আমাদের প্রভুর নহে”। কৃষ্ণনগরের মোক্তার সুযোগ বুঝে বললেন, "ধর্মাবতার, ওই সম্পত্তি আমার প্রভুর। মেলায় যে প্রকার লোক সমাগম হয়, তাহাতে আরও অনিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আমার প্রভুর বিশেষ সতর্কতার জন্য তা হয়নি।" নবাব এই কথা শুনে দোষ ক্ষমা করলেন। তখন থেকে অগ্রদ্বীপ নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সম্পত্তি হল। অন্য কথাও শোনা যায়, নবাব দরবারে কৃষ্ণচন্দ্রের পিতা নদীয়ারাজ রঘুরামের সুযোগ্য প্রতিনিধি ভবিষ্যতে মেলার সুব্যবস্থা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অগ্রদ্বীপকে আপন জমিদারিভুক্ত করেন। রাজা রঘুরাম লাভ করলেন গোপীনাথকে।

গোপীনাথ মন্দির নির্মাণ করেন কৃষ্ণচন্দ্র

অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ মন্দির (Gopinath Temple) নির্মাণ করেন কৃষ্ণচন্দ্র। ভূমিকম্পের পর থেকে এই মন্দিরের অবস্থা ভগ্নপ্রায়। মূল মন্দিরের দুই পাশে যে ভোগমন্দির ও নাটমন্দির ছিল, তা ধ্বংসপ্রায়। গোপীনাথ মন্দির হল দালান মন্দির। ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের দিক থেকে এই মন্দির তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য নয়। দীনবন্ধু মিত্র লিখেছেন: "সুগঠিত সুশোভিত মন্দির সুন্দর।” গোপীনাথ মন্দির সম্ভবত পলাশি যুদ্ধের পূর্বেই কৃষ্ণচন্দ্র নির্মাণ করেছিলেন। তিনি গোপীনাথের পুজোর জন্য কিছু দেবোত্তর জমি দান করেছিলেন। অগ্রদ্বীপের জমিদার মল্লিকরাও গোপীনাথের নামে দেবোত্তর জমি দান করেছিলেন। এখন যে জমির ওপরে গোপীনাথের মন্দির রয়েছে, সেখানে ছিল একটি আধুনিক কাপড়ের কল। ১৮২৮ সালে বিধ্বংসী বন্যায় ও ভাগীরথী বারবার বাঁক পরিবর্তনের ফলে কৃষ্ণচন্দ্র রায় নির্মিত অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ মন্দিরটি গঙ্গাগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এখনকার মন্দিরটি থেকে প্রায় এক মাইল উত্তর-পশ্চিমে ছিল কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের তৈরি মন্দিরটি। 'সম্বাদ ভাস্কর' পত্রিকা থেকে জানা যায়, বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল যশোরের বগচরের বাসিন্দা গোপীনাথ পোদ্দারের অর্থানুকূল্যে। তিনি ১৮২৩ সালে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা দান করেছিলেন।

গোপীনাথকে নিয়ে কৃষ্ণচন্দ্র-নবকৃষ্ণের বিরোধ

জানা যায়, অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ বিগ্রহ নিয়ে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে শোভাবাজারের মহারাজা নবকৃষ্ণ দেবের মাতৃশ্রাদ্ধের সময় এক ঐতিহাসিক বিরোধ হয়েছিল। মাতৃশ্রাদ্ধের সময় নবকৃষ্ণের ইচ্ছা হয়, বাংলাদেশের লোকপ্রিয় বিগ্রহগুলি কয়েকদিনের জন্যে কলকাতায় শোভাবাজার রাজবাড়িতে তাঁর মায়ের শ্রাদ্ধবাসরে নিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করে পূজার্চনা করবেন তিনি। এই ইচ্ছা কার্যকর করতে তিনি লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করেন। শ্রাদ্ধ শেষ হবার পর অন্যান্য বিগ্রহ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু অগ্রদ্বীপের গোপীনাথকে দেওয়া হয়নি। কারণ, নবকৃষ্ণ স্বপ্ন দেখেছিলেন, গোপীনাথ (Gopinath Temple) তাঁর কাছে থাকতে চান। কৃষ্ণচন্দ্র তখন জমিদারির ব্যাপারে হেস্টিংসের নতুন বন্দোবস্তের জন্য নানা দিক থেকে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত। মধ্যে মধ্যে নবকৃষ্ণের কাছে টাকার জন্যে তাঁকে হাত পাততে হত, নানা বিষয়ে উপদেশ-পরামর্শও নিতে হত। তিন লক্ষ টাকা নবকৃষ্ণের কাছ থেকে তিনি ঋণ করেছিলেন। গোপীনাথ বিগ্রহের বিনিময়ে এই ঋণ নবকৃষ্ণ মকুব করতেও রাজি ছিলেন। কিন্তু, ঋণ তো দূরের কথা, প্রাণের চেয়েও অধিকতর মূল্য হল আভিজাত্য-সামাজিক মর্যাদা। বিগ্রহ নিয়ে কলকাতা ও কৃষ্ণনগরের দুই মহারাজার মধ্যে মর্যাদার লড়াই বাধল। কৃষ্ণচন্দ্র প্রাচীন রাজবংশের বংশধর, নবকৃষ্ণ এক পুরুষের অর্বাচীন মহারাজা। বিগ্রহ নিয়ে অবশেষে মামলা হল আদালতে। কয়েক হাজার টাকা জলের মতো খরচ হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত বিরোধের মীমাংসা করলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। জয় হল কৃষ্ণচন্দ্রের। কিন্তু, নবকৃষ্ণের নয়া আভিজাত্যের গর্বোদ্ধত মাথা সহজে হেঁট হবার নয়। আরও কয়েক হাজার টাকা খরচ করে তিনি গোপীনাথের অবিকল একটি মূর্তি ওস্তাদ শিল্পীদের দিয়ে তৈরি করালেন। কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র যাঁদের মূর্তিটি আনতে পাঠিয়েছিলেন, তাঁরা সঠিক মূর্তিটি নিয়েই ফিরে আসেন। কৃষ্ণচন্দ্রের দূতরা "আনন্দ সাগরে মগ্ন হয়ে হরিহরি ধ্বনি দিয়ে স্বস্থানে প্রস্থান করলেন। রাজা নবকৃষ্ণ যে সকল বহুমূল্য আভরণ ঠাকুরকে দিয়েছিলেন তা এখনও ঠাকুরের অঙ্গে আছে। "

বারুণীর স্নান উৎসব

আগে অগ্রদ্বীপের খ্যাতি ছিল ছিল বারুণীর স্নান উৎসবের জন্যই। এই বারুণী স্নান উৎসব হয়, চৈত্রের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে। জনশ্রুতি আছে, এই উৎসবের সূচনা হয়েছিল শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের অনেক আগেই। বহু দিন থেকেই বাংলা, বিহার, বাংলাদেশ এবং ওড়িশার নানা প্রান্ত থেকে মানুষ অগ্রদ্বীপে বারুণীর স্নান উৎসবে শামিল হতে আসতেন। রেভারেন্ড ফাদার জেমস লঙের 'দ্য ব্যাঙ্কস অব ভাগীরথী' থেকে জানা যায়, ১৮২৩ সালে অগ্রদ্বীপের এই গোপীনাথ (Gopinath Temple)-বারুণী মেলার আগত ভক্তের সংখ্যা ছিল এক লক্ষের বেশি। বিক্রি হয়েছিল আনুমানিক বারো লক্ষ টাকারও বেশি। সেই সময়, গঙ্গাসাগর মেলার থেকেও অগ্রদ্বীপের বারুণীর স্নানের খ্যাতি ছিল বেশি। এই স্নানে কেউ কেউ গঙ্গাবক্ষে সন্তান বিসর্জন দিতেন। জেমস লঙ লিখেছেন, ১৮১৩ সালে চৈত্রে অগ্রদ্বীপে ও কাটোয়ায় দু'টি নারকীয় ঘটনা ঘটেছিল। যশোর ও ঢাকা থেকে এসে দু'জন তাঁদের সন্তান গঙ্গাবক্ষে বিসর্জন দিয়েছিলেন।

বারোদোলে গোপীনাথ

কৃষ্ণচন্দ্র কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে যে বারদোল মেলা প্রবর্তন করেন, সেই মেলায় এই গোপীনাথ বিগ্রহকে (Gopinath Temple) নিয়ে যাওয়া হত। দীনবন্ধু মিত্র লিখেছেন, "দ্বাদশ গোপাল মধ্যে গোপীনাথে গণে, বারদোলে দোলে তাই রাজার সদনে।" সম্প্রতি, অগ্রদ্বীপের গোপীনাথ মন্দিরের প্রণামী ও মেলা বাবদ যে মোটা টাকা রাজপরিবারের হাতে চলে যায়, তা নিয়ে অগ্রদ্বীপবাসী বনাম রাজপরিবারের বিরোধ শুরু হয়েছে। অগ্রদ্বীপবাসীরা গোপীনাথকে আর কৃষ্ণনগরে পাঠাবেন না বলে স্থির করেছেন। ফি বছর গোপীনাথ মন্দিরে মেলায় লক্ষ লক্ষ ভক্ত সমাগম হয়।

 

দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের  Whatsapp, FacebookTwitter, Telegram এবং Google News পেজ।

Share:

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn

You may also like

+ There are no comments

Add yours

Recent Articles