Bengal Politics: ডিসেম্বরেই কি ফের ভাঙাগড়ার খেলা হবে বঙ্গ রাজনীতিতে?

তৃণমূল কংগ্রেস জন্ম হওয়ার পরে এই 'কনসেপ্ট' প্রয়োগ হয় বাংলায়...
west-bengal-politics
west-bengal-politics

কালাম সিহায়ি

ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে আসন্ন মরশুমের জন্য দল বদলের "ট্রেড উইন্ডো" বন্ধ হয়ে গেল। কলকাতা নাইট রাইডার্স লকি ফার্গুসন, শার্দুল ঠাকুর এবং রহমানুল্লাহ গুরবাজকে ট্রেড করে দলে নিয়েছে৷ অর্থাৎ অন্য দলের সঙ্গে খেলোয়াড় অদলা বদলি করে এদের নিয়েছে। বদলে আবার কোনও খেলোয়াড়কে ছেড়ে দিয়েছে।

খেলোয়াড় আদান-প্রদানের এই নিয়ম ফুটবল থেকে আমদানি করা। ক্লাব ফুটবলের মরশুম শুরু হওয়ার আগে অথবা মরশুম চলাকালীনও কিছু সীমিত সময়ের জন্য এই "ট্রেড উইন্ডো" বা লেনদেনের সুযোগ পায় ক্লাবগুলি। এই ভাবে নতুন খেলোয়াড় দলে নিয়ে অথবা পুরনো কাউকে বাদ দিয়ে দলকে আরও শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা করে ক্লাবগুলি।

সাতের দশকে কলকাতার ফুটবলের কত রোমহর্ষক নাটক ঘটত এই ফুটবলারদের দলবদলকে কেন্দ্র করে। কত রক্তারক্তি, বোতল ছোড়াছুড়ি, বোমার লড়াই হতো সমর্থকদের মধ্যে। দলবদলের ১৫টি দিন, ১ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ ফুটবল উত্তেজনার পারদ আকাশছোঁয়া হয়ে যেত।

এবার মূল বিষয়ে আসা যাক। খেলার মাঠে দলবদল তো আকছার হয়ে থাকে, কিন্তু রাজনীতির ময়দানে যখন "খেলা হবে" স্লোগান দেওয়া রেওয়াজে পরিণত হয়েছে তখন খেলার মাঠের এই দলবদলের রীতি রাজনৈতিক ব্যক্তিরা গ্রহণ করলে দোষ কি!

বাংলার রাজনৈতিক মানচিত্রে কমিউনিস্টদের মধ্যে দল ভাঙানোর প্রচলন কোনওদিনই তেমনভাবে লক্ষ্য করা যায়নি। বিশেষ করে যখন বাংলায় দুই দল কেন্দ্রিক রাজনীতির প্রচলন অর্থাৎ কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের মধ্যে দড়ি টানাটানি, তখন এই প্রথা লক্ষ্য করা যায়নি তেমনভাবে।

তৃণমূল কংগ্রেস জন্ম হওয়ার পরে এই 'কনসেপ্ট' প্রয়োগ হয় বাংলায়। প্রথমে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মত বড় মাপের কংগ্রেস নেতা তৃণমূলের সঙ্গে আসন সমঝোতা করতে গিয়ে তৃণমূলে যোগ দেন। মুকুল রায়ের হাত ধরে নদিয়া জেলা সহ একের পর এক পুরসভার কংগ্রেস কাউন্সিলর ভাঙিয়ে নিয়ে বোর্ড দখল করে তৃণমূল। শুভেন্দু অধিকারীর হাত ধরে প্রায় একই চিত্র দেখা যায় মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলায়। এক সময় রাজ্য রাজনীতিতে এই দল ভাঙানো বিষয়টি চমক থেকে একেবারে সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষত ২১ জুলাই তৃণমূলের শহিদ সমাবেশের মঞ্চে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেতে থাকে যে এবার কোন কোন বিরোধী দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মঞ্চে যোগদান করতে দেখা যাবে। ২০১১ ও ২০১৬ সালে কংগ্রেসের প্রতীকে জেতা বিধায়কদের সংখ্যা প্রায় অর্ধেকে এসে ঠেকে। কেউ কেউ আবার বিধানসভার ভেতরে কংগ্রেস আর বাইরে তৃণমূল। এমনকি প্রবীণ বাম নেতা ও প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুর রেজ্জাক মোল্লাও যোগ দেন তৃণমূলে! ছোট বড় বহু বাম নেতা যেমন উদয়ন গুহ, পরেশ অধিকারী, ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় সহ আরও অনেকে তৃণমূলে নাম লেখান।

তবে একটা উল্টো স্রোত বইতে শুরু করে ২০২০ সালে এসে, অর্থাৎ ২০২১-এর নির্বাচনের এক বছর আগে থেকে। এবারে শাসক তৃণমূল দলের বিধায়করা তৃণমূল ছেড়ে বিজেপির দিকে ভিড়তে শুরু করেন। প্রতিনিয়ত বিধায়ক, মন্ত্রী ও এমনকী শাসক দলের সাংসদও বিজেপির মঞ্চে উঠে পতাকা হাতে তুলে নেন।

একুশের নির্বাচনের আগে যে যোগদান মেলা বিজেপি শুরু করেছিল তা একুশের নির্বাচনের ফলাফলের পরে ব্যুমেরাং হয়ে যায়। একাধিক বিধায়ক–সাংসদ, যাঁরা নির্বাচনের আগে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি দলে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরা নির্বাচনে পরাজয়ের পরে বিজেপির সংস্রব ছেড়ে আবার তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন। শুভেন্দু অধিকারীর মত ব্যতিক্রমী অবশ্যই আছেন, কিন্তু তা হাতে গোনা যায়। তাই হয়তো দলবদল নিয়ে এবার বিজেপি একটু বেশি সাবধানী। বেনোজল আটকাতে কার্যকরী ফিল্টার বসাতে মরিয়া বিজেপি, বিশেষ করে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

শুভেন্দু অধিকারীর স্পষ্ট বক্তব্য যে, "পিছন দরজা দিয়ে নয়, গণতান্ত্রিকভাবে সামনের দরজা দিয়েই ক্ষমতা দখল করবে বিজেপি। বাংলায় ডবল ইঞ্জিন সরকার স্থাপন হবে। তৃণমূলের ৮০ শতাংশ বিধায়কই অসৎ। এরা সকলে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মিডলম্যানের ভূমিকা পালন করে যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে অযোগ্যদের চাকরি বিক্রি করেছে। তাই এদের নিয়ে সরকার গঠন নয়। দলে আর বেনোজল ঢোকানো হবে না।"

বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদাদের বার্তা হল— ‘‘তৃণমূলের নেতাদের জন্য নয়, কর্মীদের জন্য আমাদের দরজা খোলা। এই মুহূর্তে তৃণমূলের কোনও নেতা বিজেপিতে আসতে চাইলে তাঁদের দলে নেওয়া হবে না। এমনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য বিজেপি। তৃণমূলের সব নেতাই দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই নেতা নয়, কর্মীদের আমরা দলে নেওয়ার ক্ষেত্রে দরজা খোলা রাখছি। শুধু তৃণমূলই নয়, কোনও রাজনৈতিক দলের নেতাদের নেওয়ার ক্ষেত্রেই আমাদের আগ্রহ নেই। আমরা সব দলের কর্মীদের জন্য দরজা খোলা রাখছি৷’’

তৃণমূলের কৌশল আবার একটু ভিন্ন। বিজেপিকে ভাঙাতে কোনও চেষ্টাই বাকি রাখেনি তারা। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায়শই বলে থাকেন যে, ‘‘অনেকেই বিজেপি ছেড়ে আমাদের দলে আসতে চাইছেন। তৃণমূল দরজা খুললে বিজেপি দলটাই উঠে যাবে।’’

মঙ্গলবার আবার ডায়মন্ড হারবারের সাংসদ অভিষেক বলেন, ‘‘আমরা চাইলে ডিসেম্বরের মধ্যে ওদের ৩০টা বিধায়কও থাকবে না।’’ সেই সঙ্গে তাঁর সংযোজন, ‘‘দল ভাঙানোর খেলা খেলি না।’’ প্রসঙ্গত, আগেও হলদিয়ার জনসভায় তিনি দাবি করেন যে দরজা খুললে বিজেপি দলটাই উঠে যাবে কিন্তু উনি দরজা বন্ধ করে রেখেছেন।

কিন্তু বিষয়টি হল যে, ২১ জুলাইয়ের মঞ্চে অনেকেই যোগদান করবেন বলে শোনা গিয়েছিল। প্রচুর বিজেপি বিধায়ক ও সাংসদের নাম নিয়ে জল্পনা সৃষ্টি হলেও আদতে কেউই মঞ্চে আসেননি। আর ২২ জুলাই থেকে যেভাবে একে একে তৃণমূলের মহাসচিব, মন্ত্রী, বিধায়ক, জেলা সভাপতি জেলবন্দি হয়েছেন আর এজেন্সির জেরায় বিড়ম্বনায় পড়েছেন, তাই আর কেউ ওই পথ মাড়াবেন এটা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। যদি কেউ এখনও সেই সম্ভাবনার লাভ ক্ষতি বিশ্লেষণ করে থাকেন তাহলে ওনার রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হবে।

দলবদলের রীতি যে একেবারে বন্ধ রয়েছে তা নয়। আসন্ন গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে দলবদলের কিছু টুকরো খবর প্রকাশিত হচ্ছে প্রায়শই, তবে তা একেবারে স্থানীয় স্তরে।

▪️মালদহের চাঁচলের অলিহণ্ডা গ্রাম পঞ্চায়েতের রাজনগর বুথের পঞ্চায়েত সদস্য ফুলমণি দাস তৃণমূল দল ছেড়ে শতাধিক তৃণমূলের মহিলা কর্মীদের নিয়ে কংগ্রেসে যোগ দেন।

▪️আবার অলিহন্ডা গ্রাম পঞ্চায়েতেরই শাসকদলের পঞ্চায়েত সদস্য নজরুল ইসলাম ওরফে মুকুল তৃণমূল ছেড়ে কংগ্রেসে যোগদান করেছেন। তাঁর সঙ্গে কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন প্রায় ৫০ তৃণমূল কর্মী।

এক মাসের ব্যবধানে শাসকদলের দু’জন পঞ্চায়েত সদস্যের দলত্যাগ করা পঞ্চায়েত ভোটের আগে যথেষ্ট ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।

▪️আলিপুরদুয়ারের ফালাকাটায় ধাক্কা খেল তৃণমূল। শালকুমার গ্রাম পঞ্চায়েতে শাসকদলের দুই পঞ্চায়েত সদস্য— গণেশ দাস ও যমুনা সুব্বা আনুষ্ঠানিকভাবে বিজেপিতে যোগদান করায় সংখ্যা গরিষ্ঠতা হারাতে চলেছে শাসকদল।

▪️‘অনুব্রতহীন’ বীরভূমের মুরারই দু’নম্বর ব্লকের পাইকরে তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য বাবুল আখতারের নেতৃত্বে কংগ্রেসে যোগ দিলেন এলাকার অন্তত দেড়শো কর্মী-সমর্থক।

▪️মুর্শিদাবাদের লালগোলা ব্লকের দেওয়ানসরাই পঞ্চায়েতের দখল নিল বাম কংগ্রেসের জোট। তৃণমূলের সদস্যরাই অনাস্থা নিয়ে আসে প্রধান আব্দুল কাদেরের বিরুদ্ধে।

▪️নির্দল থেকে তৃণমূল কংগ্রেসে আসা ঝালদা পুরসভার কাউন্সিলর শীলা চট্টোপাধ্যায় পদত্যাগ করলেন৷ যার ফলে পুরুলিয়ার ঝালদা পুরসভায় অনাস্থা চেয়েছে কংগ্রেস। আস্থা ভোটেকে বোর্ডের দখল নিতে পারে সেটাই দেখার।

এদিকে আবার ডিসেম্বর মাসের দিকে তাকিয়ে রাজ্যবাসী। না শীতকালের আমেজ, বড়দিনের কেক অথবা চড়ুইভাতির আয়োজনের কথা ভেবে নয়। কনকনে ঠান্ডায় রাজ্যবাসী রাজনীতির উত্তাপ নেওয়ার অপেক্ষায়। আলিপুর আবহাওয়া দফতর পারদ নামার ইঙ্গিত দিলেও রাজনৈতিক সচেতন বাঙালি বুঝে গেছেন যে রাজনৈতিক পারদ ক্রমশ বাড়ছে। বিগত কয়েক মাস ধরে দিলীপ ঘোষ, সুকান্ত মজুমদার থেকে শুভেন্দু অধিকারী সহ মাঝারি এমনকী ছোট স্তরের সব বিজপি নেতার মুখেই শোনা গিয়েছে, ‘‘তৃণমূল সরকার ডিসেম্বরে পড়ে যাবে অথবা কার্যত থাকবে না।’’ সরকার চালাতে ব্যর্থ হবেন মুখ্যমন্ত্রী, এমনকি ২০২৩ জানুয়ারি মাসের বেতন দিতে পারবে না সরকার। আর্থিক ভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়বে রাজ্য সরকার।

এমনকী মুখ্যমন্ত্রীও নাকি ক্যাবিনেট বৈঠকে মন্ত্রীদের সচেতন করেছেন ডিসেম্বরে বাড়তি সতর্ক থাকতে। এবার প্রশাসনিক বৈঠকে পুলিশ প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের সাবধান করেছেন "ডিসেম্বর ধামাকার" সম্বন্ধে। এবার ডিসেম্বর নিয়ে বিজেপিকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।

তাই ডিসেম্বর মাস নিয়ে অপার কৌতূহল তৈরি হলেও  রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের ধারণা যেমন আইপিএলের "ট্রেড উইন্ডো" আগামী মরশুমের জন্য বন্ধ হয়ে গেল, ফ্র্যাঞ্চাইজি দলগুলি যেমন আর সরাসরি নিজেদের মধ্যে ক্রিকেটার অদল বদল করতে পারবে না, ঠিক তেমনি আপাতত বঙ্গ রাজনীতিতে কোনও দলই অন্য দলের রাজ্যস্তরের কোনও বড় খেলোয়াড়কে "সই" করাবে না। আপাতত "ট্রেড উইন্ডো" বন্ধ।

Share:

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn

You may also like

+ There are no comments

Add yours

Recent Articles