মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: ঝাড়খণ্ড রাজ্যের খুন্তি জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম উলিহাতু। মেরেকটে আড়াইশো পরিবারের বাস গ্রামে। মোট জনসংখ্যা ১,১২৬। এমন গ্রামের সংখ্যা ভারতে নেহাত কম নয়। গুনতে গেলে কয়েক লাখে থামতে হবে। তবে হঠাৎ উলিহাতু নিয়ে আলোচনা কেন? কী এমন বিশেষত্ব রয়েছে এই গ্রামে ? উত্তর হল, ছোট্ট প্রত্যন্ত এই গ্রাম এক দেশ বিখ্যাত যোদ্ধার জন্মভূমি। যাঁকে তার অনুগামীরা 'ধরতি আবা' বলতেন। অর্থাৎ কিনা স্বয়ং ভগবান। যাঁকে দমানোর জন্য ব্রিটিশ সেনাবাহিনীকে পর্যন্ত মাঠে নামতে হয়েছিল। তিনি মুন্ডা বিদ্রোহের অবিসংবাদী নেতা ভগবান বিরসা মুন্ডা (Birsa Munda)। মুন্ডা শব্দটি সংস্কৃত থেকে উৎপত্তি হয়েছে যার প্রকৃত অর্থ 'গ্রাম প্রধান'।
১৮৭৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন বিরসা, মুখস্থ ছিল রামায়ণ-মহাভারত
১৮৭৫ সালের ১৫ নভেম্বর এক গরীব পরিবারে জন্ম হয় বিরসা মুন্ডার (Birsa Munda)। পার্থিব জীবন মাত্র ২৫ বছরের ছিল কিন্তু তিনি আজও বেঁচে রয়েছেন শোষণ, বঞ্চনা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতীক হিসেবে। জীবিত অবস্থাতেই তিনি 'ভগবান বিরসা মুন্ডা' নামে খ্যাতি লাভ করেন। কোটি কোটি ভারতবাসীর হৃদয়ে শ্রদ্ধার আসনে তিনি আসীন। ভারতের জনজাতি এলাকাগুলিতে খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্মান্তকরণ ব্রিটিশ আমল থেকেই চালু রয়েছে। ছোট্ট প্রত্যন্ত গ্রামে বিরসা মুন্ডাকে খ্রিস্টান ধর্মের উপাসনা করার জন্য জোর করা হলে, তিনি গ্রামের খ্রিস্টান স্কুল ত্যাগ করেন। বিরসা মুন্ডা হিন্দুধর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বলে জানা যায়। নিজগৃহের বিভিন্ন দেবতার প্রতি তাঁর পরম ভক্তি ছিল। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি বৈষ্ণব ধর্মগুরু আনন্দ পাঁড়ের কাছে দীক্ষা নেন। খাদ্যাভাসে ছিলেন নিরামিষাশী। কণ্ঠস্থ ছিল রামায়ণ-মহাভারত।
অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য সেনাবাহিনী গঠন
১৮৯৪ সালে ভয়াবহ খরা দেখা দিল। নির্দয় ব্রিটিশ সরকার তবুও কর সংগ্রহ করছিল সাধারণ মানুষের উপর অত্যাচার করে। ওই বছরেই ব্রিটিশ সরকার অরণ্য আইন বলবৎ করে। অরণ্যের উপর জনজাতিদের অধিকার খর্ব হয়। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সংকল্পবদ্ধ হন তরুণ বিরসা মুন্ডা (Birsa Munda)। স্থানীয় মানুষজনকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সেনাবাহিনী তৈরির কাজ শুরু করেন। ১৮৯৫ সালেই 'কর মুক্ত' আন্দোলন করার অপরাধে তাঁকে জেলে পাঠানো হয়। দুই বছর জেলে থাকার পরে ১৮৯৭ সালে তিনি মুক্তি পান। পুনরায় শুরু হয় বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে ঐতিহাসিক আন্দোলন। ছোটনাগপুরে শুরু হয় তীর ধনুক নিয়ে আন্দোলন।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ
১৮৯৮ সালে টাঙ্গা নদীর তীরে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিরসা মুন্ডার যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাজিত করতে সমর্থ হন তিনি। যুদ্ধজয়ের পর তিনি বলেন, ‘‘প্রথমবার আমরা জয়লাভ করেছি। কিন্তু এর বিরূপ প্রভাব শত শত মানুষ ভোগ করেছে। শত শত মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নির্যাতন করা হয়েছে। এত নির্যাতনের পরেও থামেনি মানুষের সংগ্রাম।’’ ১৯০০ সালে ডোবাড়ি পাহাড়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ সংঘর্ষে অনেক নারী ও শিশু নিহত হন। বিরসা মুন্ডাকে ধরতে তাঁর মাথার দাম ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে ব্রিটিশ সরকার। নিরস্ত্র বিরসাকে জঙ্গলের মধ্যে ঘুমন্ত অবস্থায় গ্রেফতার করে ব্রিটিশ সরকার। কথিত আছে, কারাগারে থাকাকালীন খাবারে বিষ মিশিয়ে বিরসা মুন্ডাকে (Birsa Munda) হত্যা করা হয়। ১৯০০ সালের ৯ জুন স্বর্গযাত্রা করেন ভগবান বিরসা মুন্ডা।
বিরসার জন্মদিন 'জনজাতি গৌরব দিবস'
ঝাড়খণ্ড, বিহার, ছত্তিসগড়, পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশাতে আজও পর্যন্ত লাখ লাখ মানুষ 'বিরসা মুন্ডা'কে 'ভগবান বিরসা মান্দা' হিসাবে পূজা করে থাকেন। এমন একজন ঐশ্বরিক ব্যক্তিত্ব যিনি তরুণ প্রজন্মের প্রেরণার কেন্দ্র ,- যিনি ভারতের সম্পদ, তিনি ব্রাত্য থেকেছে বরাবর। তাঁর প্রাপ্য সম্মান পাননি। স্বাধীনতার পর থেকেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কয়েক বছর আগে 'মন কি বাতে', 'ভগবান বিরসা মুন্ডা'র দুঃসাহসিক গল্প স্মরণ করেন এবং ঘোষণা করেন, তাঁর জন্ম-জয়ন্তী, প্রতি বছর 'জনজাতি গৌরব দিবস' হিসাবে উদযাপন করা হবে।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook, Twitter এবং Google News পেজ।
+ There are no comments
Add yours