স্বামী অলোকেশানন্দ
জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ কাজের জন্য সর্ব শক্তি প্রয়োজন। এই শক্তি শুধু দেহের শক্তি বা ক্ষমতার কথা বলছি না। এই শক্তির কথা বলতে গেলেই প্রথমে মনে পড়ে কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে অর্জুনের সারথী শ্রীকৃষ্ণের কথা। যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে অর্জুনের শোক, সংকটময় মনের অবস্থা। বুদ্ধি বিভ্রম অবস্থায় তিনি (অর্জুন) যা বলেছেন, তার উত্তর শ্রীকৃষ্ণ খুব শান্তভাবে, নিষ্কামভাবে, ধীরস্থিরভাবে দিয়েছেন বা বলেছেন, যা আমরা গীতার মধ্যে দেখতে পাইা কী অসম্ভব শান্ত অবস্থায় সাংখ্য যোগ, কর্ম যোগ, জ্ঞান যোগ, ভক্তি যোগ ইত্যাদি বিষয়ে বলেছেন, যা নিয়ে আজ এবং ভবিষ্যতে দীর্ঘ কাল চর্চা চলবে। যে যুক্তি বা বাণী বা কথাগুলি শ্রীকৃষ্ণ বললেন, তা সর্বকালের জন্য উপযুক্ত। শ্রীকৃষ্ণ যে সময় পৃথিবীতে এসেছিলেন, সেই যুগের উপযোগী করে সাধারণের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন তাঁর বাণী। ভগবান বলেছিলেন, আর শুনেছিলেন সাধারণ মানুষের হয়ে অর্জুন। কী অসম্ভব কর্ম করে গেলেন শান্ত মস্তিষ্কে। ভাবতেই শিহরণ হয় শরীরে।
আমরা সবাই অর্জুন, স্বামীজি (Swami Vivekananda) হলেন কৃষ্ণ
সেই রকম একালেও স্বামীজির (Swami Vivekananda) বাণী বা বক্তৃতাগুলি পড়লে আমার মনে হয়, আমরা সাধারণ মানুষ সবাই অর্জুন, আর স্বামীজি হলেন কৃষ্ণ। গীতাতে অর্জুনের কথাগুলি ছিল আমার মতো সাধারণ মানুষের। এই যুগে সাধারণ মানুষের কী প্রয়োজন? কী করতে হবে তাঁদের? ভবিষ্যতে তাঁরা কী করবেন? সব বলে গেছেন স্বামীজি। কৃষ্ণের সময় বিশেষ সঙ্কট ছিল ধর্ম ও অধর্মের সংঘাত। স্বামীজির সময় ছিল বহু ধর্মের সংঘাত। সাম্রাজ্যবাদের সংঘাত। দরিদ্রদের শোষণ করার সংঘাত, ভাষার সংঘাত, সাদা-কালোদের মধ্যে সংঘাত, শিক্ষা, অর্থনীতি আরও আরও অনেক রকম সংঘাত। তিনি সেগুলি পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য উপযুক্ত করে নির্দেশ দিয়ে গেলেন, ভুল ধরলেন, আবার উপায় বার করে দিয়ে গেলেন। সমস্যার সমাধান করলেন এই যুগের জন্য, যা চিরকাল চলবে।
কী বলেছেন স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda)?
এই অসম্ভব কর্ম শ্রীকৃষ্ণের মতো করে গেলেন স্বামী বিবেকানন্দ, যা যত জানি, শরীরে ততই শিহরণ হয়। এইরূপ কর্মযোগীদের মতো বড় বড় কাজ করতে গেলে চাই সাধারণ মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ। চাই একাগ্রতা, চাই মনের সংযম, চাই লক্ষ্য স্থির করা, চাই আত্মবিচার, ত্যাগ ইত্যাদি ইত্যাদি এবং শান্ত ও ধীরস্থির মস্তিষ্ক। স্বামীজি বলতেন, আমার ভক্তরা আমার থেকেও বড় হবে। আমি বলি, কাজ করবে। স্বামীজির বাণী অধ্যয়ন করে, অনুধাবন করে আমার যা মনে হয়, কর্মযোগীর মতো কাজ করতে গেলে তিনি বাক সংযম শুধু নয়, দেহের বিভিন্ন ইন্দ্রিয় সংযমের কথা বলেছেন।
স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda) বলছেন, "আমরা যতই শান্ত হই, ততই আমাদের নিজেদের মঙ্গল, ততই আমরা আরও বেশি করে কাজ করতে পারি। যখন আমরা ভাবাবেগ সংযত করতে পারি না, তখনই আমাদের শক্তির বিশেষ অপব্যয় হয়, আমাদের স্নায়ু-মণ্ডলী বিকৃত হয়, মন চঞ্চল হয়ে ওঠে, কিন্তু কাজ খুব কম হয়। যে শক্তি কাজে পরিণত হওয়া উচিত ছিল, তা শুধুমাত্র হৃদয়াবেগেই পর্যবসিত হয়। মন যখন খুব শান্ত ও স্থির থাকে, কেবল তখনই আমাদের সমুদয় শক্তি সৎ কাজে নিয়োজিত হয়। যদি তোমরা জগতে বড় বড় কর্মকুশল ব্যক্তির জীবনী পাঠ কর, দেখবে তাঁরা অদ্ভুত শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিলেন, কোনও কিছুই তাঁদের চিত্তের সমতা নষ্ট করতে পারে না। এজন্য যে ব্যক্তি সহজেই রেগে যায়, সে বড় একটা কাজ করতে পারে না। আর যে কিছুতেই রাগে না, সে সর্বাপেক্ষা বেশি কাজ করতে পারে। যে ব্যক্তি ক্রোধ, ঘৃণা বা কোনও রিপুর বশীভূত হয়ে পড়ে, সে এ জগতে বড় কিছু একটা করতে পারে না, সে নিজেকে যেন খণ্ড খণ্ড করে ফেলে এবং সে বড় একটা কাজের লোক হয় না। কেবল শান্ত, ক্ষমাশীল, স্থির চিত্ত ব্যক্তিই সর্বাপেক্ষা বেশি কাজ করে থাকেন।"
আমার কাছে এই বড় বড় কাজের ব্যক্তিরা হলেন স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda), শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীচৈতন্য, বুদ্ধ, যীশু, শ্রীরামকৃষ্ণ প্রমুখ।
+ There are no comments
Add yours