বঙ্গের প্রথম সার্বভৌম হিন্দু রাজা শশাঙ্ক
ড. সুমনচন্দ্র দাস
বৃহৎ বঙ্গদেশের প্রথম সার্বভৌম বাঙালি রাজা হলেন শশাঙ্ক (Shashanka)। তবে তাঁর সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা স্বল্পবিস্তর তথ্য সন্ধান করতে পেরেছিলেন। প্রাচীন রোহিতাশ্বরের গিরিগাত্রে ‘শ্রীমহাসামন্ত শশাঙ্ক’ এই নাম খোদাই করা আছে। তিনি ছিলেন শৈবভক্ত হিন্দু রাজা এবং গৌড়ের নরপতি (Hindu king of Bengal)। এই তথ্যের ভিত্তিতে তাঁকেই বঙ্গের প্রথম মহাসামন্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়। তাঁর সময়কাল আনুমানিক মনে করা হয় খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের শেষ। তাঁর রাজ্যাভিষেকের দিন থেকেই হিন্দুশাস্ত্র মতে সৌর মাসের শকাব্দ গণনা শুরু হয়। পরবর্তীতে বাংলা সনের বঙ্গাব্দ ক্যালেন্ডার ও গণনার কালানুক্রম ধরা হয়। কিন্তু তাঁকে বীর বাঙালি রাজা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় উপেক্ষা করা হয়েছে।
উত্তরে কামরূপ থেকে দক্ষিণে উৎকল পর্যন্ত সাম্রাজ্য (Shashanka)
খুব স্পষ্ট করে বলা যায়, অনুমানিক ৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে নিজের স্বাধীন সাম্রাজ্যের অধিপতি হন এই হিন্দু রাজা। তাঁর রাজধানী ছিল বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার কর্ণসুবর্ণ নামক জায়গায়। এই জায়গাটি এখনও প্রাচীন সাম্রাজ্যের ইতিহাস বহন করে চলেছে। রাজ্য বিস্তারে তিনিও বিরাট কীর্তিমান ছিলেন। তাঁর রাজ্য দক্ষিণে বর্তমান মেদিনীপুর জেলার দন্ডভুক্তি, উৎকল, গঞ্জাম, কোঙ্গোদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আবার পশ্চিমে বারাণসী পর্যন্ত আধিপত্য ছিল। একাধিক তাম্র শাসন থেকে জানা যায়, উত্তরের কামরূপ রাজ্যের সুস্থিত বর্মণের মৃত্যুর পর তাঁর দুই পুত্র সুপ্রতিষ্ঠিত বর্মণ এবং ভাস্কর বর্মণ গৌড়ের সৈন্যদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন। কিন্তু কিছু দিন পরেই আবার তাঁদের মুক্ত করে দেন এই গৌড়ের রাজা। তবে এই সম্পর্কে ইতিহাসকারেরা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারেননি। কিন্তু অনুমানকে আশ্রয় করা হলেও মহাসেনগুপ্তের সামন্ত হিসেবে যে শশাঙ্কের (Shashanka) কথা পাওয়া যায়, তাতে তিনিই প্রথম বাঙালি রাজা ছিলেন। তিনি উত্তর থেকে দক্ষিণে এত বড় সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন। আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প মতে, মাত্র ১৭ বছর রাজত্ব করেছিলেন তিনি। এই তথ্য ঠিক নয়, কারণ হিউ-এন-সাং ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দের আগেই মৃত্যুর কথা জানিয়েছেন। কিন্তু শশাঙ্কের প্রচলিত তাম্রশাসন যে পাওয়া গিয়েছিল, তাতে ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। ফলে তাঁর জীবনকাল নিয়ে ঠিক করে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
ইতিহাসে মিথ্যা কথন
আর্যাবর্তে বাঙালির সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রথম নায়ক রাজা শশাঙ্ক (Shashanka)। রাজা শশাঙ্ক সম্পর্কে হিউ-এন-সাং বর্ণিত তথ্যে রয়েছে, তিনি কুশিনগর বৌদ্ধ বিহার থেকে বৌদ্ধদের বিতাড়িত করেন, পাটলিপুত্রের বুদ্ধের পদচিহ্ন অঙ্কিত প্রস্তরখণ্ড জলে ফলে দেন এবং গয়ার বোধিবৃক্ষ ছেদন করে আগুন দেন। এমনকী বলা হয়, বুদ্ধদেবের মূর্তি ভাঙার সময় শরীরে ক্ষত হলে পরবর্তী কালে মারা যান সেই রোগেই। এখন প্রশ্ন হল, এই শৈব রাজা যদি সম্পূর্ণভাবে এতটাই বৌদ্ধ বিদ্বেষী হতেন, তাহলে নিজের কর্ণসুবর্ণ রাজধানীর কাছে বিরাট রত্নমৃত্তিকা বৌদ্ধ মহাবিহার কেন অক্ষত ছিল? সেই সঙ্গে আরও ১০টি মহাবিহারের কীভাবে অস্তিত্ব ছিল? অপর দিকে বাণভট্ট নিজের কাব্যে এই শৈব রাজাকে একাধিকবার গৌড়াধম, গৌড়ভূজঙ্গ বিশেষণে মন্তব্য করেছেন। তাই রাজ্যবর্ধনের হত্যা প্রসঙ্গে যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি ইতিহাসের পাতায়। শশাঙ্ক (Hindu king of Bengal) সম্পর্কে আরও নিবিড় পাঠের প্রয়োজন।
ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মত
বানভট্ট ‘হর্ষচরিত’-এ এবং চৈনিক পর্যটক হিউ-এন-সাং রাজা শশাঙ্কের (Hindu king of Bengal) সম্পর্কে যেসব কথার উল্লেখ করেছেন, তাতে তাঁর সম্পর্কে কলঙ্ক লেপন হয়েছে মাত্র। তাই ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার, “বাংলাদেশের ইতিহাস”-বইতে বলেছেন, “বাণভট্টের মত চরিত লেখক অথবা হিউ-এন-সাংয়ের মতো সুহৃদ লেখক থাকলে হর্ষবর্ধনের মতো তাঁহার খ্যাতিও চতুর্দিকে বিস্তৃত হতো। কিন্তু অদৃষ্টের নিদারুণ বিড়ম্বনা তিনি স্বদেশে অখ্যাত ও অজ্ঞাত এবং শত্রুর কলঙ্ক-কালিমাই তাঁহাকে জগতে পরিচিত করিয়াছে।”
তাম্রশাসনের শিলালিপি
রাজা শশাঙ্কের (Shashanka) জারি করা তিনটি তাম্রলিপি পাওয়া গিয়েছে। মেদিনীপুর থেকে আবিষ্কৃত হয়েছিল এই উপাদনগুলি। এগরা এবং খড়গপুরের কাছে এই তাম্রশাসন পাওয়া গিয়েছিল। একই ভাবে বর্তমান মেদিনীপুরে অবস্থিত শরশঙ্কা নামে একটি বিশাল দিঘি আবিস্কার হয়েছে। মূলত জলের সঙ্কট দূর করতে প্রজাদের কল্যাণের জন্য এই জলাধার তৈরি করেছলেন রাজা শশাঙ্ক। মোট জমির মাপ ছিল ১৪০ একরের বেশি। এর মধ্যেই হিন্দু বাস্তুশাস্ত্র, কারিগরি বিদ্যা, স্থাপত্য এবং নান্দনিকতার স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছে। বিখ্যাত ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় শশাঙ্ককে নিয়ে একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনাও করেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ১৯১৪ সালে। আদতে বাঙালির রাজা কতটা সুশাসক ছিলেন, সেই দিকেই আলোকপাত করেছেন তিনি।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।
+ There are no comments
Add yours