মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: নবরাত্রির (Navaratri 2023) সপ্তম দিনে আরাধিত হন মাতা কালরাত্রি। বাংলাতে প্রচলিত দুর্গাপুজোর মহাসপ্তমীর দেবী তিনি। মাতা কালরাত্রি ভীষণ দর্শনা, এলোকেশী। তাঁর চারটি হাত। ওপরের ডান হাতে আশীর্বাদ, নীচের ডান হাতে অভয় মুদ্রা। বাঁ দিকে ওপরের হাতে খড়্গ এবং নিচের বাম হাতে রয়েছে লোহার কাঁটা। দেবী ত্রিনয়নী এবং তাঁর চোখগুলি গোলাকার। দেবীর গলায় রয়েছে বজ্রের মালা। এই দেবীর বাহন গাধা এবং তাঁর নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ভয়ঙ্কর অগ্নিশিখা নির্গত হয় বলে কথিত আছে। দেবী কালরাত্রি সম্পর্কে অজস্র পৌরাণিক আখ্যান রয়েছে। তিনি চণ্ড-মুণ্ড নামের দুই অসুরকে বধ করেছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর অপর নাম তাই "চামুণ্ডা"। দেবী মাহাত্ম্যতে উল্লেখ রয়েছে, শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক দুই দানব ছিলেন। তাঁরা প্রজাপতি ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা করলেন। খুশি হয়ে প্রজাপতি ব্রহ্মা বর দিতে আবির্ভূত হলেন। দুই দানব বর চাইলেন যে, কোনও পুরুষ যেন তাঁদের বধ করতে না পারে। ব্রহ্মা তাঁদের বর প্রদান করলেন। এরপরই দুই অসুর চরম অত্যাচার শুরু করলেন দেবতাদের উপর। এই দুজনের সঙ্গে যোগ দিল চণ্ড-মুণ্ড নামের আরও দুই অসুর। তাঁদের সঙ্গে এল রক্তবীজ। যাঁর প্রতিটি রক্তবিন্দু মাটিতে পড়লে দ্বিতীয় রক্তবীজ তৈরি হবে। প্রজাপতি ব্রহ্মার এমনটাই বরদান ছিল তাঁর উপর। এই সমস্ত অসুরদের অত্যাচারে দেবতারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। অসুরদের ওপর ব্রহ্মার বরদান সম্পর্কেও দেবতারা অবগত ছিলেন। মুনি-ঋষিদের যজ্ঞ পণ্ড করা, ঋষিকন্যাদের নানাভাবে লাঞ্ছিত করা এসব কাজ তো চলছিলই। অসুরদের এমন আক্রমণে দেবতারা অবশেষে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। নিজেদের স্বর্গরাজ্য থেকে তাঁরা বিতাড়িত হলেন। দেবতারা হিমালয়ের কোলে শুরু করলেন দেবীর স্তব। দেবী মাহাত্ম্যতে এই স্তব সম্পূর্ণভাবে উল্লেখ রয়েছে। কিছুটা অংশ সংযোজিত করা হল। কমবেশি এই স্তব সকলেই আমরা জানি।
মাতা কালরাত্রির স্তব
যা দেবী সর্বভূতেষু বিষ্ণুমাযেতি শব্দিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ
যা দেবী সর্বভূতেষু চেতনেত্যভিধীযতে
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ
যা দেবী সর্বভূতেষু বুদ্ধিরূপেণ সংস্থিতা
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ
যা দেবী সর্বভূতেষু নিদ্রারূপেণ সংস্থিতা
নমস্তস্যৈনমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ
যা দেবী সর্বভূতেষু ক্ষুধারূপেণ সংস্থিতা .
নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ
পুরাণে কথিত রয়েছে, এমন সময় সেখান দিয়ে শিবজায়া দেবী পার্বতী গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন (Navaratri 2023)। দেবী তাদের স্তব শুনে বললেন, “হে দেববৃন্দ, আপনারা এখানে কার স্তব করছেন?” সেই সময় ভগবতী পার্বতীর শরীর থেকে একই রকম দেখতে আর এক জন দেবী বেরিয়ে এলেন। আবির্ভূত হয়ে নব দেবী বললেন, “দেবতারা আমার স্তব করছেন।” এই দেবীই আদ্যাশক্তি জগত মাতা অম্বিকা মহামায়া। তিনি দেবী পার্বতীর কোষ থেকে সৃষ্টি হয়েছেন বলে তার এক নাম কৌষিকী। কথিত আছে এর পর নাকি দেবী পার্বতী কৃষ্ণবর্ণা হয়ে যান। যাঁকে আমরা কালরাত্রি বলি। ইনি মাতা কালিকা নামেও পরিচিত।
অসুরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
পুরাণে আরও উল্লেখিত আছে, দেবী (Navaratri 2023) একদিন হিমালয়ে সিংহপৃষ্ঠে বসে মধু পান করছিলেন। এমন সময় চণ্ড আর মুণ্ড নামক দুই দানব দেবীকে দেখতে পেলেন। চণ্ড-মুণ্ড একথা গিয়ে শুম্ভ-নিশুম্ভকে জানালেন। শুম্ভ-নিশুম্ভ সেই দেবীর রূপ বর্ণনা শুনে দেবীকে লাভ করার জন্য আকুল হলেন। সুগ্রীব নামক এক অসুর দেবীর কাছে গেল শুম্ভ-নিশুম্ভের দূত হিসেবে। সুগ্রীব হিমালয়ে সেই পর্বত চূড়ায় গিয়ে দেবীকে শুম্ভ-নিশুম্ভের পরাক্রম, ঐশ্বর্যের কথা বলে বিবাহের প্রস্তাব দিল। দেবী একথা শুনে হেসে বললেন, ‘‘আমার প্রতিজ্ঞাটি শোন–যিনি আমাকে যুদ্ধে জয় করবেন, তিনিই আমার স্বামী হবেন।’’ এরপর শুম্ভ-নিশুম্ভের সেনাপতি ধুম্রলোচন ষাট হাজার সেনা নিয়ে গেলেন দেবীকে পরাজিত করতে। দেবীর তেজে ধুম্রলোচন ভস্মীভূত হলেন। দেবীর সিংহবাহিনী অসুর সেনাকে ধ্বংস করে দিল। শুম্ভ-নিশুম্ভ এরপর চণ্ড ও মুণ্ডকে পাঠাল। চণ্ড ও মুণ্ড বহু সেনা, অশ্ব, রথ, হাতি নিয়ে যুদ্ধে এসে হিমালয়ের চূড়ায় হাস্যরত দেবী অম্বিকাকে দেখতে পেলেন। দেবী চণ্ডিকা তাঁদের দেখে ভীষণ ক্রুদ্ধা হলেন। ক্রোধে তাঁর মুখমণ্ডল কৃষ্ণবর্ণা হল। তখন দেবীর কপাল থেকে এক ভীষণ দর্শনা দেবী প্রকট হলেন। তিনিই দেবী কালিকা বা কালরাত্রি। অতি ভীষণা, ভয়ঙ্করী, কোটর গতা, আরক্ত চক্ষু বিশিষ্টা। সেই ভয়ঙ্করা দেবী ভীষণ হুঙ্কার দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন। কতগুলি অসুরকে দেবী তাঁর চরণ ভারে পিষে বধ করলেন। কোনও কোনও অসুর দেবীর খড়্গের আঘাতে মারা গেল। যুদ্ধক্ষেত্রে এই ভাবে দেবী অসুরদের ধ্বংস করে ফেললেন। এরপর দেবী তাঁর খড়্গ তুলে ‘হং’ শব্দ করে চণ্ডের দিকে ধেয়ে গেলেন। দেবী চণ্ডের চুলের মুঠি ধরে খড়্গ দ্বারা এক কোপে চণ্ডের শিরোচ্ছেদ করে ফেললেন। চণ্ড অসুর বধ হল। চণ্ড নিহত হয়েছে দেখে ক্রোধে মুণ্ড দেবীর দিকে ধেয়ে গেল। দেবী তাঁর রক্তাক্ত খড়্গ দিয়ে আর এক কোপে মুণ্ডের শিরোচ্ছেদ করলেন। এভাবে মুণ্ড বধ হল। চণ্ড-মুণ্ড বধ হতে দেখেই দেবতারা আনন্দে দেবীর জয়ধ্বনি দিতে থাকলেন। দেবী মাহাত্ম্য অনুযায়ী, চণ্ড আর মুণ্ড-এর ছিন্ন মস্তক নিয়ে দেবী, মহামায়ার কাছে এসে বিকট হেসে বললেন, “এই যুদ্ধরূপ যজ্ঞে আমি আপনাকে চণ্ড ও মুণ্ড নামে দুই মহাপশুর মস্তক উপহার দিলাম। এখন আপনি নিজেই শুম্ভ ও নিশুম্ভকে বধ করবেন।” দেবী অম্বিকা তখন বললেন, “ হে দেবী, যেহেতু তুমি চণ্ড ও মুণ্ডের বধ করে মাথা দুটি আমার নিকট নিয়ে এসেছ, সেজন্য আজ থেকে তুমি জগতে ‘চামুন্ডা’ নামে বিখ্যাত হবে।’’ মাতা কালরাত্রি শুভফলের দেবী বলেও অনেকে মনে করেন। তাই মাতার আরেক নাম হল "শুভঙ্করী"। মাতা কালরাত্রির আশীর্বাদে জীবনের সমস্ত কুপ্রভাব বিনষ্ট হয় বলে ভক্তদের ধারণা। মাতার নৈবেদ্যতে গুড় নিবেদন (Navaratri 2023) করলে তিনি প্রসন্না হন বলে ভক্তদের ধারণা।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook, Twitter এবং Google News পেজ।
+ There are no comments
Add yours