জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি - পর্ব ২
প্রথম পর্বের পর...
৬। কয়েকমাস পর ব্রিটিশ সরকার তাদের ৩ জুন ঘোষণা (১৯৪৭) প্রদান করে যাতে ভারত ভাগ বিষয়ে কিছু প্রস্তাবনার কথা বলা হয়। পুরো দেশ, বিশেষ করে সমগ্র অমুসলিম ভারত এতে হতবাক হয়ে যায়। সত্যি কথা বলতে আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে মুসলিম লিগের পাকিস্তান দাবিকে আমি সবসময় শুধুমাত্র দরকষাকষির অংশ হিসেবেই দেখে এসেছি। যদিও আমি বিশ্বাস করি যে ভারতের সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অন্যায় প্রভাবের বিরুদ্ধে মুসলিমদের ক্ষোভ ন্যায়সঙ্গত, এ বিষয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গী পরিষ্কার যে পাকিস্তানের জন্ম সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান কখনও করতে পারবে না। বরঞ্চ, এটা কেবলমাত্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও শত্রুতা বৃদ্ধিই করবে। পাশাপাশি আমি এই ধারণা পোষণ করতাম যে পাকিস্তানের জন্ম হলে মুসলিমদের অবস্থা উন্নত হবেনা। দেশভাগের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসেবে আসবে দরিদ্রতা, অশিক্ষা এবং উভয় দেশের জনগণের দুর্দশা যা অনির্দিষ্টকাল না হলেও বহুদিন ধরে চলতে থাকবে। আমার আশঙ্কা ছিল পাকিস্তান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে পশ্চাৎপদ এবং অনুন্নত দেশগুলোর একটিতে পরিণত হবে।
লাহোর ঘোষণা
৭। আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম যে পাকিস্তানকে ইসলামী শরিয়ত নিয়ম-নীতির উপর ভিত্তি করে একটি সম্পূর্ণ ‘ইসলামী’ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস করা হবে, যা এখন করা হচ্ছে। আমার অনুমান ছিল ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মুসলিম লিগের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে সকল গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ ঘটানো হবে। এই প্রতিবেদনে ছিল প্রথমত, ভৌগলিকভাবে পাশাপাশি অবস্থিত স্থানসমূহ প্রয়োজনীয় ভূমির অদল-বদলের মাধ্যমে এমনভাবে ভাগ করা হবে যেন ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলের মত মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে স্বাধীন-সার্বভৌম একাধিক রাষ্ট্র গঠন করা যায় এবং দ্বিতীয়ত, এসব অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের নিজস্ব ধর্ম, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং অন্যান্য স্বার্থ-অধিকার রক্ষার নিমিত্তে তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংবিধানে যথেষ্ঠ, কার্যক্ষম ও আবশ্যিক নিরাপত্তা প্রদানের ধারা যুক্ত করা হবে। এই ঘোষণার মধ্যে অন্তর্নিহিত ছিল ক) উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বের মুসলিম অঞ্চলগুলোতে ২টি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা হবে, খ) এই রাষ্ট্রগুলো হবে স্বাধীন ও স্বায়ত্বশাসিত, গ) সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও অধিকার সুরক্ষিত থাকবে এবং জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে তা ভূমিকা রাখবে এবং ঘ) সংবিধানে সংখ্যালঘুদের এই সাংবিধানিক অধিকার তারা নিজেরাই ঠিক করবে। গণপরিষদের সভাপতি হিসেবে কায়েদ-ঈ-আজম মহম্মদ আলি জিন্নার ১১ অগাস্ট ১৯৪৭ সালে প্রদত্ত ভাষণ, লিগের এই ঘোষণা লিগ নেতৃবৃন্দের প্রতি আমার বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করে। এই ভাষণে তিনি হিন্দু ও মুসলিম উভয় পক্ষকেই সমানভাবে বিবেচনার দৃঢ় আশ্বাস প্রদান করেন এবং তাদের আহ্বান করেন এটা মনে রাখতে যে তারা সবাই পাকিস্তানি। তাই ধর্মের ভিত্তিতে সেখানে নাগরিকদের মুসলিম এবং জিম্মি (অমুসলিম) এভাবে ভাগ করার কোনও প্রশ্নই ছিলনা।
এই প্রতিটি প্রতিশ্রুতিই আপনার জ্ঞাতসারে এবং সম্মতিতে লঙ্ঘন করা হয়েছে। এখানে কায়েদ-ই-আজমের ইচ্ছাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সংখ্যালঘুদের নানা ভাবে অপমান এবং ক্ষতি করা হয়েছে।
জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি - পর্ব ১
বাংলা ভাগ হল
৮। এই প্রসঙ্গে এটা বলে রাখা ভাল যে বাংলা ভাগের সময় আমাকে প্রবল বিরোধের মুখে পড়তে হয়েছিল। এই ধরণের প্রচারের ফলে আমি শুধু বিরোধিতার সম্মুখীন হই নাই, হয়েছি শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত, অপমানিত এবং অবজ্ঞার শিকার। হতাশার সঙ্গে আমি সেই সব দিনের কথা চিন্তা করতে চাই যখন ভারতবর্ষের ৩২ কোটি হিন্দু আমাকে হিন্দু এবং হিন্দু ধর্মের শত্রু বানিয়েছিল। কিন্তু আমি ছিলাম পাকিস্তানের প্রতি একান্ত অনুগত এবং এই দেশের প্রতি ছিল আমার অবিচল আস্থা। আমি চিন্তা করতাম পাকিস্তানের ৭০ লক্ষ হিন্দু দলিতের কথা যারা ছিল আমার সঙ্গে। তারাই আমাকে সর্বদা সাহস এবং প্রেরণা যুগিয়েছে।
৯। ১৯৪৭ সালের ১৪ অগাস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পর আপনি পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা গঠন করেন। আমি এই মন্ত্রিসভার একজন সদস্য ছিলাম। খাজা নাজিমুদ্দিন পূর্ব বাংলার জন্য একটি প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা গঠন করেন। অগাস্টের ১০ তারিখে আমি করাচিতে খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে পূর্ব বাংলার মন্ত্রিসভায় নমঃশূদ্রদের মধ্যে থেকে ২ জনকে নিয়োগ করার জন্য অনুরোধ করি। তিনি কিছুদিন পরেই তা করবার আশ্বাস দেন। পরবর্তীতে এ ব্যাপারে আপনার, খাজা নাজিমুদ্দিন এবং পূর্ব বাংলার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনের সঙ্গে আমার অপ্রীতিকর এবং হতাশাজনক রফা হয়। যখন আমি বুঝতে পারলাম যে খাজা নাজুমুদ্দিন এই-সেই অজুহাতে ব্যাপারটিকে এড়িয়ে চলছেন তখন আমি একইসঙ্গে ক্রুদ্ধ এবং অধৈর্য হয়ে পড়লাম। আমি এই ব্যাপারে পাকিস্তান মুসলিম লিগে এবং এর পূর্ব বাংলা শাখার সভাপতিদ্বয়ের সঙ্গেও আলোচনা করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমি ঘটনাটি আপনার গোচরে আনি। এরপর আপনি সাগ্রহে আমার উপস্থিতিতে আপনার গৃহে খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে এই ব্যাপারে আলোচনা করেন। খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় ফিরে অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ভুক্ত একজনকে মন্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত হন। তাঁর আশ্বাসের ব্যাপারে ইতিমধ্যেই সন্দেহ করতে শুরু করি এবং কাজটি সম্পাদনের নির্দিষ্ট সময়-সূচী জানতে চাই। আমি জোর দাবি জানাই এই ব্যাপারে এক মাসের মধ্যে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য, অন্যথায় পদত্যাগের ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্তে কেউ বাধা দিতে পারবে না। আপনারা দুজনেই এই প্রস্তাবে সম্মতি প্রদান করেন। কিন্তু হায়, সম্ভবত আপনার মুখের কথা আপনার মনের প্রতিচ্ছবি ছিল না। খাজা নাজিমুদ্দিন তার প্রতিশ্রুতি পালন করেননি। জনাব নুরুল আমিন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হবার পর আমি তাঁর কাছেও এই বিষয়টি নিয়ে যাই। তিনিও সেই পুরোনো এড়িয়ে চলার নীতি চালিয়ে যান। ১৯৪৯ সালে আপনার ঢাকা সফরের প্রাক্কালে যখন আমি ব্যাপারটি আবারও আপনার গোচরে আনি। আপনি আমাকে আশ্বস্ত করেন যে পূর্ব বাংলায় সংখ্যালঘু মন্ত্রী অবশ্যই নিয়োগপ্রাপ্ত হবে। আপনি আমার কাছে বিবেচনার জন্য ২/৩ জনের নামও চান। আপনার আবেদনের প্রতি সশ্রদ্ধ বাধ্যবাধকতা প্রদর্শন করে আমি আপনার কাছে পূর্ব বাংলা পরিষদের ফেডারেশন গ্রুপ এবং ৩ জনের নাম সুপারিশ করে চিঠি পাঠাই। আপনি ঢাকা থেকে ফেরার পর এবিষয়ে আমি খোঁজ নিতে গেলে আপনি কঠোর মনোভাব প্রকাশ করেন এবং “নুরুল আমিনকে দিল্লি থেকে ফিরতে দাও” কেবলমাত্র এই মন্তব্যটুকু করেন। কিছুদিন পর আমি আবার বিষয়টি তুলে ধরি, কিন্তু আপনি তা এড়িয়ে যান। তখন আমি এই উপসংহারে আসতে বাধ্য হই যে আপনি বা নুরুল আমিন কেউই চান না যে পূর্ব বাংলা মন্ত্রিসভায় কোনও নমঃশূদ্র ব্যক্তি মন্ত্রী হোক। এছাড়াও আমি দেখতে পাচ্ছিলাম যে জনাব নুরুল আমিন এবং পূর্ব বাংলা লিগের কিছু নেতৃবৃন্দ নমঃশূদ্রদের ফেডারেশন সদস্যদের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছিলেন। আমার কাছে প্রতীয়মান হয় যে আমার নেতৃত্ব এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তাকে খারাপ চোখে দেখা হচ্ছে। পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে নমঃশূদ্রদের স্বার্থ রক্ষায় আমার স্পষ্টবাদিতা, তদারকি এবং আন্তরিক কার্যকলাপ পূর্ব বাংলা সরকার এবং লিগের কিছু নেতার মনে বিরক্তির সৃষ্টি করে। কিন্তু এসব কিছুর পরোয়া না করে আমি পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষায় দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করি।
জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি -পর্ব ৩
হিন্দু বিদ্বেষী নীতি
১০। বাংলা ভাগের প্রসঙ্গ উঠতেই নমঃশূদ্ররা এর বিপজ্জনক ফলাফলের কথা অনুমান করে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিল। তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জনাব সোহরাওয়ার্দীর কাছে তারা কিছু প্রতিনিধি পাঠালে তিনি সানন্দে একটি প্রেস রিলিজ ইস্যু করেন যাতে বলা ছিল নমঃশূদ্ররা ভোগ করছে এমন কোনও সুবিধা ও অধিকারকে কখনও হরণ করা হবেনা, বরং তা আরও বৃদ্ধি পাবে। জনাব সোহরাওয়ার্দীর এই আশ্বাস কেবলমাত্র ব্যক্তিগত ভাবেই দেননি, লিগ মন্ত্রিসভার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবেও দিয়েছেন। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে ভারত ভাগের পরে, বিশেষ করে কায়েদ-ঈ-আজমের মৃত্যুর পর থেকে নমঃশূদ্ররা কোনও বিষয়েই তাদের প্রাপ্য অধিকার পায়নি। আপনার স্মরণে থাকবে যে আমি সময়ে সময়ে এই অস্পৃশ্য জাতিগোষ্ঠীর দুর্দশার চিত্র আপনার সামনে তুলে ধরেছি। বেশকিছু ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার বেহাল প্রশাসনিক চিত্র আপনার কাছে ব্যাখ্যা করেছি। পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ দাখিল করেছি। মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশের বর্বর নৃশংসতার ঘটনাসমূহও আমি আপনার নজরে এনেছি। পূর্ব বাংলার সরকার বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসন ও মুসলিম লিগের নেতৃবৃন্দের একাংশের হিন্দু বিদ্বেষী নীতির কথা আপনাকে জানাতেও আমি কুণ্ঠাবোধ করিনি।
(ক্রমশ............)
জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি - পর্ব ১
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook এবং Twitter পেজ।
+ There are no comments
Add yours