Jogendra Nath Mandal: ‘‘কেন আমি মুসলিম লিগকে সমর্থন করি?’’

পাকিস্তানের প্রথম আইন এবং শ্রমমন্ত্রী ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। ১৯৫০ সালের ৯ অক্টোবর তিনি পদত্যাগ করেন লিয়াকত আলি খানের মন্ত্রিসভা থেকে। তাঁর পদত্যাগপত্র সাতটি পর্বে প্রকাশ করছি আমরা।
jogen
jogen

জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি - পর্ব ১

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,

পূর্ব বাংলার পিছিয়ে পড়া হিন্দু সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য জীবনভর আমার প্রয়াস সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে, এমন সময়ে চরম হতাশা এবং দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমি আপনার মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করছি। আমার মনে হয় আমার জানানো উচিত কেন ভারতীয় উপমহাদেশের এই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে আমি এই সিদ্ধান্ত নিলাম।

১। আমার পদত্যাগের কারণগুলো বলার আগে, আমার মনে হয় মুসলিম লিগের সঙ্গে থাকাকালীন যে যে ঘটনাগুলো ঘটেছিল তার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। ১৯৪৩ সালে ফেব্রুয়ারিতে লিগের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার কথায় আমি তাঁদের সঙ্গে বাংলার প্রাদেশিক আইনসভায় কাজ করার বিষয়ে সম্মত হই। ১৯৪৩ সালের মার্চে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার পতনের পর, আমার সঙ্গে থাকা আইনসভার ২১ জন নমঃশূদ্র সদস্যের প্রত্যক্ষ সমর্থনে তদানীন্তন মুসলিম লিগের পরিষদীয় দলনেতা খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৩ সালের এপ্রিলে মন্ত্রিসভা গঠন করতে সক্ষম হন। আমাদের সমর্থনের পিছনে কিছু শর্ত ছিল। যেগুলি হল, মন্ত্রিসভায় তিনজন নমঃশূদ্র মন্ত্রীকে রাখতে হবে, নমঃশূদ্রদের শিক্ষার উন্নয়নে ৫ লক্ষ টাকা সহায়তা প্রদান করতে হবে এবং সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক অনুপাতের বাইরে তফশিলি প্রার্থীদের নিয়োগ করা।

২। এসব শর্তের বাইরেও মুসলিম লিগকে সমর্থন করার পিছনে আমার কিছু প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত, বাঙালি মুসলিমদের সঙ্গে নমঃশূদ্রদের অর্থনৈতিক স্বার্থের মিল রয়েছে। মুসলিমরা ছিল মূলত কৃষক-শ্রমিক এবং তফশিলিরাও তাই। মুসলিমদের একটি অংশের মত নমঃশূদ্রদেরও একটি অংশ ছিল মৎস্য শিকারী। দ্বিতীয়ত, তারা উভয়েই ছিল শিক্ষার দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। আমাকে বোঝানো হয়েছিল যে লিগ এবং এর মন্ত্রিসভার সঙ্গে আমার সহযোগিতা ব্যাপক পরিসরে আইনগত এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়তা করবে। এই পদক্ষেপসমূহ ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সুবিধাকে আমল না দিয়ে বাংলার এই বিশাল জনগোষ্ঠীর পারস্পরিক উন্নতিতে ভূমিকা রাখবে এবং সাম্প্রদায়িক শান্তি-সৌহার্দ্য আরও মজবুত হবে, এমনটিই বলা হয়েছিল। এখানে উল্লেখ করা যায় যে খাজা নাজিমুদ্দিন তাঁর মন্ত্রিসভায় তফশিলি জাতির ৩ জন সদস্যকে নিয়েছিলেন এবং আমার সমাজ  থেকে ৩ জনকে সংসদ সচিব হিসেবেও নিয়োগ করেছিলেন।

সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা

৩। ১৯৪৬ সালে মার্চ মাসের সাধারণ নির্বাচনের পর জনাব এইচ.এস সোহরাওয়ার্দী সেই মাসেই লিগের সংসদীয় দলনেতা হন এবং ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে লিগের মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ফেডারেশনের টিকিটে কেবলমাত্র আমিই আমার সমাজের মধ্যে নির্বাচনে জয়লাভ করতে সক্ষম হই। আমি জনাব সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলাম। ওই বছরের ১৬ অগাস্ট কলকাতায় মুসলিম লিগ ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’-এর ডাক দেয়। আপনার জানা আছে যে শেষ পর্যন্ত এটা এক গণহত্যার রূপ নিয়েছিল। হিন্দুরা লিগের মন্ত্রিসভা থেকে আমার পদত্যাগপত্র দাবী করে। আমি প্রতিদিন চিঠির মাধ্যমে হুমকি পেতে থাকি। আমার জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। কিন্তু আমি আমার নীতিতে অবিচল থাকি। তারসঙ্গেই, আমি আমার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের পত্রিকা ‘জাগরণ’ এর মাধ্যমে নমঃশূদ্রদের কাছে আবেদন জানাই তারা যেন নিজেদের কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের এই রক্তাক্ত লড়াই থেকে দূরে রাখে। আমার অস্পৃশ্য সমাজভুক্ত প্রতিবেশীগণ যেভাবে আমাকে ক্রুদ্ধ হিন্দুদের হাত থেকে নিরাপত্তা দিয়েছিল তা আমি কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করি। কলকাতা হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৪৬ সালের অক্টোবরে শুরু হয় নোয়াখালীর দাঙ্গা। সেখানে শত শত হিন্দু সমাজভুক্ত মানুষকে (নমঃশূদ্র সহ) হত্যা করা হয় এবং জোরপূর্বক ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়। হিন্দু মহিলারা অপহরণ এবং ধর্ষণের শিকার হন। আমার সমাজভুক্ত মানুষেরও জীবন-জীবিকার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। তাৎক্ষণিকভাবে আমি ত্রিপুরা ও ফেনী যাই এবং কিছু দাঙ্গাপীড়িত এলাকা পরিদর্শন করি। হিন্দুদের দুর্দশা আমাকে গভীরভাবে ব্যথিত করে, কিন্তু তারপরেও আমি মুসলিম লিগের সঙ্গে সহযোগিতা চালিয়ে যাই। কলকাতার বিশাল গণহত্যার পরেই সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে এক অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়। ভোটাভুটি আয়োজিত হয়। শুধুমাত্র আমার চেষ্টার ফলেই কংগ্রেসে পক্ষের চারজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সদস্য এবং চারজন তফশিলি সদস্যের সমর্থন জোগাড় করা সম্ভব হয় যা ব্যতীত মন্ত্রিসভার পতন ছিল অবশ্যম্ভাবী।

৪। ১৯৪৬ সালের অক্টোবরে একরকমের অপ্রত্যাশিতভাবেই জনাব সোহরাওয়ার্দীর মাধ্যমে আমার কাছে প্রস্তাব আসে ভারতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে একটি পদ গ্রহণ করার জন্য। এক ঘণ্টার মধ্যে আমাকে আমার সিদ্ধান্ত জানাতে বলা হয়। বেশকিছু সময় দোদুল্যমান থাকার পর আমি এই শর্তে রাজি হই যে আমার নেতা ড.বি.আর অম্বেডকর যদি আমাকে ওই জায়গায় না চান তবে আমাকে পদত্যাগের অনুমতি প্রদান করা হবে। ভাগ্যক্রমে, তিনি লন্ডন থেকে টেলিগ্রামের মাধ্যমে তাঁর অনুমতি প্রদান করেন। অন্তর্বতী সরকারের আইন সদস্য হিসেবে যোগদানের লক্ষ্যে দিল্লির উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে আমি তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জনাব সোহরাওয়ার্দীকে রাজি করাতে সক্ষম হই যে তিনি আমার স্থানে ২ জনকে আমার সমাজ থেকে মন্ত্রিসভায় জায়গা দেবেন। তিনি তফশিলি জাতির ফেডারেশন গ্রুপ থেকে ২ জনকে সংসদ সচিব হিসেবে নিয়োগ দিতেও সম্মত হন।

৫। আমি ১৯৪৬ সালের ১ নভেম্বর অন্তর্বতী সরকারে যোগ দিই। এক মাস পর কলকাতাতে আমি যাই। তখন জনাব সোহরাওয়ার্দী আমাকে জানালেন পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জায়গাতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার কথা। বিশেষ করে গোপালগঞ্জ মহকুমার কিছু জায়গাতে যেখানে নমঃশূদ্ররা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন সেই অঞ্চলগুলো পরিদর্শনে যেতে এবং মুসলিম ও নমঃশূদ্রদের মাঝে সমঝোতা করতে। সেইসব এলাকার নমঃশূদ্ররা মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমি কয়েক ডজন সভা করে তাদেরকে সেই পথ থেকে দূরে সরিয়ে আনি। একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে ওই এলাকাগুলি মুক্তি পায়।

(ক্রমশ............)

 

দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook এবং Twitter পেজ।
 

Share:

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn

You may also like

+ There are no comments

Add yours

Recent Articles