মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: সন্ধি পুজোর আগে নিয়ম করে শূন্যে গুলির আওয়াজে মায়ের আগমনী বার্তা (Durga Puja 2023) জানানোই ছিল এই বাড়ির রেওয়াজ। ২২৯ বছরে পড়ল পাঠক বাড়ির দুর্গাপূজা। এই সাবেকি পুজো চালু করেছিলেন তালচিনানের জমিদার কৃষ্ণকান্ত পাঠক। সূত্র অনুযায়ী, বর্ধমান মহারাজার জনার্দন মন্দিরের সেবাইত ছিলেন পাঠকরা। মহারাজা তাঁদের খুশি হয়ে হুগলির তালচিনান গ্রামের জমিদারির স্বত্ব দেন। কৃষ্ণকান্ত পাঠক হয়ে যান তালচিনানের জমিদার। চুঁচুড়া স্টেশন থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার পশ্চিমে পোলবা-দাদপুর ব্লকের একটি গ্রাম এই তালচিনান। ওই জমিদার বংশের বংশধর রাজকমল পাঠক জানান, কৃষ্ণকান্ত শুধু তালচিনান নয় এরপর ক্রমশ চাঁদপুর, মহেশপুর, হিরণ্যবাটি তৌজির মালিক হয়ে যান। দশ হাজার বিঘা খাস জমি ছিল তাঁদের। ভাবতে পারা যায়! প্রজাদের দেওয়া খাজনায় চলত জমিদারি।
কুলদেবতা জনার্দন
পাঠকদের কুলদেবতা জনার্দন। তাই জমিদারির পাশাপাশি জনার্দনের মন্দিরও গড়ে ওঠে। কৃষ্ণকান্ত জমিদারি পেয়েই দুর্গাপুজো (Durga Puja 2023) চালু করেন। তবে জনার্দনের পূজারি হওয়ায় এখানে পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। আজও তালচিনানে পাঠক বাড়ির দুর্গাপুজো দেখতে ভিড় করেন গ্রামের পর গ্রামের মানুষজন। আসলে এঁরাই ছিলেন এক সময় এই জমিদারের প্রজা। বছরভর এই পাঠকবাড়ি সুনসান থাকলেও পুজোর কটা দিন প্রায় সমস্ত আত্নীয়স্বজন চলে আসেন। ভবনের খান বত্রিশেক ঘর তখন গমগম করে। বাড়ির সামনে বিশাল দুর্গা দালান, সেখানে তিনখিলানের মাঝে একচালা কাঠামোয় দেবী বিরাজ করেন। কথিত আছে এই পুজোর শুরু থেকে আজ অবধি কাঠামোর কোনও পরিবর্তন হয়নি। এখানে বলি হয় তবে আখ, চালকুমড়ো, বাতাবি লেবু, শসা ভিন্ন কিছু নয়। অষ্টমী-নবমীতে কুমারী পুজোর প্রচলনও আছে।
অদ্ভুত এক মানসিক শান্তি
এই জমিদার বাড়িতে অদ্ভুত একটা মানসিক শান্তি বিরাজ করে। নিস্তব্ধ নিঝুম মহলের চারপাশে পায়রার বক বকম...। মনটা যেন ফিরে যেতে চায় পিছনে, আরও পিছনে। "আসলে আমি ছাড়া আর কেউ আসে না এই বাড়িতে পুজোর সময়টুকু ছাড়া। প্রত্যেকেই বাইরে থাকেন, কেউ রাজ্যের, কেউ দেশের। সময় কোথায়? তাই আমিই মাঝে মাঝে কলকাতা থেকে ছুটে আসি। কাটিয়ে দিই কয়েকটা দিন।" জানালেন রাজকমল পাঠক। তিনি বলেন, যে রীতি পূর্বপুরুষরা করে গিয়েছিলেন, সেই রীতিই যতটা সম্ভব আমরা পালন করি। যেমন এই জমিদার বাড়িরই নিজস্ব পুকুর থেকে মাটি এনে দেবীর মূর্তি (Durga Puja 2023) গড়া হয়। পুরোহিত বংশ সেই একই। আগে বাড়ির দোনলা বন্দুক থেকে তোপ ফাটানো হত সন্ধিক্ষণে, এখন আমার লাইসেন্স প্রাপ্ত বন্দুক থেকে ফাটাই। পুজোর প্রতিটা দিন আমাদের কাছে বিশেষ দিন।
নিরঞ্জনেরও কিছু বৈশিষ্ট্য
ষষ্ঠীর (Durga Puja 2023) দিন বোধন। ওইদিন পরিবারের সদস্যরা সবাই একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেন। সপ্তমীর দিন আমিষ হয়। আগে নিজেদের পুকুর থেকে মাছ ধরে খাওয়ানো হত। এখন পুকুর লিজে দেওয়ার ফলে বাজার থেকেই কাতলা মাছ এনে এই গ্রামের জ্ঞাতি, ব্রাম্ভণরা এখানে ভুরিভোজ করেন একসঙ্গে। অষ্টমীর দিন গ্রামের মহিলারা এখানে দুপুরে লুচি খান। নবমীতে বর্গক্ষত্রিয়রা আসেন। দশমীতে থাকে লুচি, বোঁদে আর সিদ্ধি। ঠাকুর বরণের পর হয় সিঁদুর খেলা। তাতে গ্রামের মহিলারাও যোগ দেন। পাঠকবাড়ির প্রতিমা নিরঞ্জনেরও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। বাঁশের মাচায় তোলা হলে গ্রামের বর্গক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের মানুষজন কাঁধে করে প্রতিমা গোটা গ্রাম ঘুরিয়ে স্থানীয় পুকুরে বিসর্জন দেন। পাঠক বাড়ির প্রতিমা বিসর্জন না হলে গ্রামের অন্য কোনও প্রতিমার বিসর্জন হয় না। এটাই এই গ্রামের রীতি। এটাই পুরনো জমিদারবাবুদের প্রতি গ্রামের মানুষের শ্রদ্ধা। আর এইভাবেই চলে আসছে বাংলার বনেদি বাড়ির পুজো। জমিদারি প্রথা উঠে গেলেও জমিদারি রীতিনীতি এখনও প্রাণপণে রক্ষা করতে মরিয়া উত্তরসূরিরা।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook, Twitter এবং Google News পেজ।
+ There are no comments
Add yours