মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: পূর্ব বর্ধমানের ছোট্ট শহর গুসকরা। সেখানকার ঐতিহ্যবাহী চোঙদার বাড়ির দুর্গাপুজো, যার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কুনুর নদী। কথিত আছে সম্রাট শের শাহের আমলে এই বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু হয়। প্রায় ৪৫০ বছর ধরে মহা সমারোহে বেশ রাজকীয়ভাবেই সম্পন্ন হয় এই বাড়ির পুজো (Durga Puja 2023)। বর্তমানে জৌলুস কিছুটা কমলেও পরিবারের সদস্যরা ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।
ঘট বিসর্জন হয় না (Durga Puja 2023)
গুসকরার জমিদার চতুর্ভুজ চোঙদারের হাত ধরেই এই পুজো শুরু হয়েছিল বলে জানা যায়। জমিদার বাড়ির কেন্দ্রস্থলেই তৈরি হয় বিরাট দুর্গা মন্দির। এক সময় কলকাতার নামী কোম্পানির নট্টবাবুরা গুসকরার এই বাড়িতে গিয়ে যাত্রাপালার আসর জমাতেন। বারান্দার পলেস্তারা এখন প্রায় খসে পড়েছে। তবুও ধুমধাম করেই পুজোর (Durga Puja 2023) চারটে দিন মেতে ওঠেন বাড়ির বড় থেকে ছোট সবাই৷ যাঁরা বাইরে থাকেন, পুজোর সময় মোটামুটি সবাই একজোট হন। চোঙদার বাড়ির দুর্গাপুজোর কথা উঠলেই মনে পড়ে যাবে এখানকার রীতি ও প্রথার ছবি। যেমন, এখানে ঘট বিসর্জন হয় না, ঘট আহ্বান করা হয়৷ নিঃসন্দেহে এই প্রথা অন্যরকম একটি দিক। দশমীর দিন যে ঘট প্রতিষ্ঠা করা হয়, তা রেখে দেওয়া হয় টানা এক বছর। পরের বছর ষষ্ঠীর দিন তা বিসর্জন হয়। বাড়ির বধূ মল্লিকা চোঙদার বলেন, ‘পরিবারের মঙ্গল কামনায় দশমীর দিন এই ঘট বিসর্জন করা হয় না। এ ছাড়াও সপ্তমী থেকে দশমী, চার দিনই প্রদীপ জ্বেলে রাখা হয়।
বন্দুকে ফায়ার করে সন্ধি পুজো (Durga Puja 2023)
এক সময় কামান দাগা হত। এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এখন বন্দুকে ফায়ার করে সন্ধি পুজো শুরু হয়। শাক্ত মতে পুজো হয় এই বাড়িতে। ১৯৭৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় মারা যায় প্রচুর গবাদি পশু। সেই থেকে এখানে মোষ ও ছাগ বলি বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকে চালকুমড়ো বলির প্রথা চালু রয়েছে। ভোগ রান্না হয় ৫১ থালার। বাড়ির মহিলারাই সাধারণত ভোগ রান্না করেন। এছাড়াও থাকে এলাকাবাসীদের পাত পেড়ে খাওয়ানো। প্রায় ৪৫০ বছরের প্রাচীন এই পুজো নিঃশব্দে বলে দেয় ইতিহাসের কত কথা। পুজোর চারটে দিন বাড়ি মুখর হয়ে ওঠে ঢাকের আওয়াজ আর উলু-শঙ্খধ্বনিতে। সুদৃশ্য দুর্গা দালান আলো দিয়ে সাজানো হয় পুজোর (Durga Puja 2023) দিনগুলিতে।
আগে সাতটি গ্রামের প্রজারা পুজোর দিনগুলিতে অন্নভোগ খাওয়ার নিমন্ত্রণ পেতেন। জমিদারি বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রথা বিলুপ্ত হলেও নিষ্ঠার সঙ্গে মা আসেন চোঙদার বাড়ির এই দুর্গা দালানে। বাঁশের চোঙে রাজস্ব আসতো। তাই পদবি চোঙদার। বর্ধমান রাজার কাছ থেকে এলাকার জমিদারি পাওয়ার পর ত্রিপুরেশ্বর চোঙদার দুর্গা দালান তৈরি করেন। তার আগে তালপাতার ছাউনিতে দুর্গাপুজো হতো। জমিদারি পাবার পর পরিবারে আর্থিক সমৃদ্ধি আসে। দুর্গা দালান তৈরির পাশাপাশি জাঁকজমকের সঙ্গে দুর্গাপুজো শুরু হয়। সাতটি গ্রামে বিস্তৃত ছিল জমিদারি। পুজোর দিনগুলিতে সেই সাত গ্রামের বাসিন্দারা জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজো দেখতে আসতেন। ভোগ খাওয়ার পর পালা গান, যাত্রা শুনে বাড়ি ফিরতেন তাঁরা। দুর্গা দালানের পাশে রয়েছে ভোগ ঘর। এলাকাজুড়ে রয়েছে শতাধিক উনানের ভগ্নাংশ। সেইসব উনানেই জমিদারি আমলে অন্নভোগ তৈরি হত। আশপাশের জমিদাররা নিমন্ত্রণ পেতেন। নামী শিল্পীরা আসতেন। আসতেন বর্ধমানের মহারাজের প্রতিনিধিরাও। এখন সেসব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে পরিবারের সদস্যরা পুজোর চারদিন বেশিরভাগ সময় এই দুর্গা দালানেই কাটান।
দুর্গা মন্দিরে স্বেচ্ছামৃত্যু (Durga Puja 2023)
কথিত আছে, দশমীতে চর্তুভুজ চোঙদার ও তাঁর স্ত্রী বিদ্যাসুন্দরী দেবী দুর্গা মন্দিরে (Durga Puja 2023) স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেন। সেই থেকেই দশমীর দিনে মা দুর্গার সামনে চর্তুভুজ ও বিদ্যাসুন্দরীর শ্রাদ্ধ দেওয়া হয়। সময় ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটলেও এখনও সেই প্রথা চালু রয়েছে। তবে সেইসব পর্ব শেষে দশমীতে সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন পরিবারের মহিলারা। এখানে মা দুর্গার ছেলেমেয়েদের মধ্যে গণেশ ছাড়া অন্য কোনও দেবদেবীর বাহন নেই। সরস্বতীর শুভ্র বেশ। দেবী দুর্গা অষ্টমুখী ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে এখানে অধিষ্ঠান করেন।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook, Twitter এবং Google News পেজ।
+ There are no comments
Add yours