মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: দীপাবলি উৎসব শেষ হওয়ার পরেই আদিবাসীরা সোহরাই (Sohrai) উৎসবে মেতে ওঠেন। কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষে পালিত হয় এই উৎসব। চলতি বছরে, সোহরাই উৎসব শুরু হয়েছে গত ১ নভেম্বর থেকে। ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা, ছত্তিশগড় ও পশ্চিমবঙ্গে বেশ জাঁকজমকভাবেই এই উৎসব পালন হতে দেখা যায়। প্রসঙ্গত, সোহরাই হল ছয় দিনের উৎসব। কোথাও কোথাও ৩ থেকে ৫ দিনের উৎসবও হয় এটি। দীপাবলির পরে দেশজুড়ে যে গোবর্ধন পুজো হয়, সেই উৎসবের সঙ্গে অনেক মিল দেখা যায় সোহরাইয়ের (Sohrai)। সাঁওতাল বা আদিবাসীদের অন্যতম বড় উৎসব হল এই সোহরাই। সোহরাই মূলত পশু পালনের উৎসব। রীতি অনুযায়ী, গ্রামবাসীরা এই উৎসবে গরু ও ষাঁড়ের পুজো করে থাকেন।
সোহরাই (Sohrai) উৎসবের কাহিনী
আদিবাসীদের বিশ্বাস, প্রাচীনকালে অয়নী, বায়ানি, সুগি, সাওয়ালি, কড়ি ও কপিল- এই সমস্ত নামে দৈবক্ষমতাসম্পন্ন গবাদিপশু ছিল। এই গবাদিপশুরা স্বর্গ লোকে থাকত ভগবান শিবের কাছে। আদিবাসী ভক্তদের বিশ্বাস, তাঁদের দেবতা মারাংবুরু ভগবান শিবের চেয়ে কম শক্তিশালী ছিলেন না। মূলত শিশুদের দুধের প্রয়োজন মেটাতে মারাংবুরুর অনুরোধেই এই গবাদিপশুরা মর্ত্যলোকে এসেছিল। মারাংবুরু, দৈবক্ষমতাসম্পন্ন এই গবাদিপশুগুলিকে বলেছিলেন, পৃথিবীর মানুষ যুগ যুগ ধরে তাদের উপাসনা করবেন। সোহরাই একটি ফসল কাটারও উৎসবও বটে। সাঁওতাল, ওরাওঁ, মুন্ডা প্রভৃতি উপজাতি এই উৎসবের (Cattle Festival) মাধ্যমে তাঁদের গবাদি পশুর সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করেন। প্রসঙ্গত, আদিবাসীদের কাছে নিজেদের পরিবারের ভরণ পোষণ এবং জীবিকার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হল গবাদিপশু। তাই সোহরাইয়ের (Sohrai) মাধ্যমে সেই গবাদি পশুগুলিকে পুজো করার রীতি দেখা যায়।
গবাদি পশুদের আবাসস্থল গোয়ালঘর কার্যত মন্দিরে পরিণত হয়
উৎসবের (Sohrai) মাধ্যমে গ্রামবাসীরা নাচ-গানে মেতে ওঠেন। কেউ কেউ লাঠি খেলাও দেখাতে থাকেন। প্রতিটি আদিবাসী বাড়িতেই সোহরাই গান গাওয়া হয়। সোহরাই উৎসবকে কেন্দ্র করে গবাদি পশুদের আবাসস্থল গোয়ালঘর কার্যত মন্দিরে পরিণত হয়। নিজেদের মতো করে আদিবাসীরা গোয়ালঘর সাজিয়ে তোলেন। এখানে মাটির প্রদীপে জ্বলে। গরু-ষাঁড়ের শিং-এ তেল দেওয়া হয়। উৎসবের দিনগুলিতে মাঝিথান বা গ্রামের উপাসনালয়গুলিতে বিশেষ পুজো করা হয়। এই পুজো খুন্তদেব পুজো নামেও পরিচিত।
গবাদি পশুদের (Cattle Festival) বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়
গ্রামবাসীরা সোহরাইয়ের দিনগুলিতে গবাদি পশুদের কপালে সিঁদুর লাগান ও মালা পরান। গবাদি পশুদের এই দিন বিশেষ যত্ন নেওয়া হয় এবং বিশেষ খাবার দেওয়া হয়। সোহরাইয়ের প্রায় এক মাস আগে থেকে আদিবাসীরা লাঠি দিয়ে গরু-মহিষকে আঘাত করাও বন্ধ করে দেন। এই উৎসবে স্থানীয় পুকুর ও জলাশয়গুলি থেকে গ্রামবাসীরা মাছ ও কাঁকড়া ধরেন। এছাড়া, তাঁরা কাছাকাছি বনে শিকার করতেও যান।
কী বলছেন গবেষক?
রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ে নাগপুরী ভাষার অধ্যাপক বীরেন্দ্র কুমার মাহতো বলেন, ‘‘গড় পুজো দিয়ে সোহরাই উৎসব শুরু হয়। স্তূপ করা ধান এদিন একটি খোলা জায়গায় রাখা হয়। ধানের স্তূপে একটি ডিমও রাখা হয়। তারপরে, গরু এবং ষাঁড়গুলিকে স্তূপের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। যে গবাদি পশু ডিম ভাঙতে পারে, তাকে ভাগ্যবান বলে গণ্য করা হয় এবং পুজো করা হয়।’’
উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়
উৎসবকে (Cattle Festival) কেন্দ্র করে বিবাহিত মেয়েরা তাঁদের বাপের বাড়িতে যান। কবে অনুষ্ঠিত হবে এই উৎসব সেরকম নির্দিষ্ট কোনও দিনক্ষণ নেই। আদিবাসী গ্রামের মাথারা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে এই উৎসবের দিন ঠিক করেন। সোহরাই উৎসবে খোলা মাঠে বাঁশের মাথায় সাদা পতাকা (ঝান্ডি) বাঁধা হয়। তারপর এর চারদিক ঘিরে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে নারী-পুরুষের নাচ-গান। বিভিন্ন সাঁওতাল গ্রামগুলিতে দেখা যায় অনুষ্ঠানকে ঘিরে দূরদূরান্ত থেকে আসা প্রতিযোগীরা দলবদ্ধ হয়ে নাচ-গান পরিবেশন করছেন। উৎসব ঘিরে বিভিন্ন প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়। একেবারে শেষে সোহরাই উৎসব কমিটি বিজয়ী প্রতিযোগিতার মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন।
নারী-পুরুষদের সাজ পোশাক
এ সময় আদিবাসী রমণীদের হলুদ-লাল ও সাদা-লাল পাড়ের শাড়ি পরতে দেখা যায়। তাঁরা নিজেদের সাজাতে গায়ে অলঙ্কার পরেন, খোঁপায় বাহারি রঙের ফুল বাঁধেন। হাতে ফুলের চুরি, পায়ে নূপুর পরে নাচ-গানে সামিল হন। অন্যদিকে, পুরুষদের পরনে থাকে সাদা ধুতি, গায়ে গেঞ্জি, মাথায় পাগড়ি। গলায় মাদল ঝুলিয়ে দলবদ্ধ হয়ে কাঁধে কাঁধ, হাতে হাত রেখে ঢাকঢোল পিটিয়ে নৃত্য পরিবেশন করেন তাঁরা। এই নৃত্য বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে।
দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Whatsapp, Facebook, Twitter, Telegram এবং Google News পেজ।
+ There are no comments
Add yours