Rajbanshi People: খাদ্যাভ্যাস থেকে সংস্কৃতি, কেমন হয় রাজবংশী জনজাতির জীবনধারা?

কোচ রাজবংশী জনজাতি ঐতিহ্যগতভাবে একটি বৃহৎ কৃষিজীবী জনজাতির অঙ্গ ছিল...
rajbanshi-2
rajbanshi-2

শুক্লা শিকদার

একটি সাম্প্রতিক গবেষণা নির্দেশ করে যে রাজবংশী বা কোচ রাজবংশী জনজাতির কৃষি, নৃত্য, সঙ্গীত, চিকিৎসা অনুশীলন, গান, বাড়ি নির্মাণ, সংস্কৃতি এবং ভাষার মৌখিক ঐতিহ্য রয়েছে। ২০১৯ সালের উক্ত গবেষণা অনুসারে, রাজবংশী জনজাতি আদর্শভাবে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের কাছে জ্ঞান ও জীবনশৈলীর খুঁটিনাটি হস্তান্তর করে আসছে। 

কোচ রাজবংশী জনজাতি ঐতিহ্যগতভাবে একটি বৃহৎ কৃষিজীবী জনজাতির অঙ্গ ছিল। তারা মূলত ধান, ডাল এবং ভুট্টা চাষাবাদে অভ্যস্থ ছিল। রাজবংশী জনজাতির মধ্যে অধিকাংশের প্রধান খাদ্য ভাত। এমনকি একবিংশ শতকেও, এই জনজাতির একটি বড় অংশ এখনও গ্রামীণ জীবনধারা মেনে চলে। যদিও ক্রমশ নগরায়নের প্রভাব তাদের জীবনধারায়ও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তবে অসম, পশ্চিমবঙ্গ, নেপাল, বাংলাদেশ, মেঘালয়ের সমস্ত রাজবংশী জনজাতির মধ্যে খাদ্য ও পানীয়ের গ্রহণে লক্ষণীয় সামঞ্জ্যস্য দেখা যায়। অর্থাৎ অঞ্চলিক বিভিন্নতা সত্ত্বেও কোচ জনজাতির খাদ্যপ্রণালী একই রকম। তাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় শাকসবজি এবং ভাজা (প্রধানত আলু) সহ চাল এবং ডাল পাওয়া যায়। 

ঢেকির সাগ এবং নাফা সাগ, দুই ধরনের শাক-সবজি রাজবংশীদের মধ্যে খুবই প্রচলিত। ফার্নের পাতার সদ্য জন্মানো অঙ্কুর জাত তেল থেকে খুব অল্প পরিমান তেল ব্যবহার করে তারা শাক সবজি সাধারণত সিদ্ধ করে খান। নাম্নী অসমে, বাঁশের অঙ্কুরকেও সবজি হিসেবে প্রস্তুত করে খাওয়া হয়। কোচ রাজবংশীর মধ্যে বাসি ভাত বা পান্তা ভাত খাওয়া দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় খুবই  প্রচলিত। শাক-সবজি ব্যতীত অন্যান্য রান্না প্রধানত সরিষার তেল ব্যবহার করে করা হয়, যদিও কখনও কখনও সূর্যমুখী তেল ব্যবহার করা হয়। 

আমিষ জাতীয় খাবারের ক্ষেত্রে, কোচ রাজবংশী জনগোষ্ঠী বঙ্গীয় অঞ্চলের অন্যান্য আশেপাশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ ভাবে প্রচুর পরিমাণে মাংস এবং ডিম খায়, যেখানে বঙ্গীয় অঞ্চলের জনজতিরা আমিষ হিসেবে মৎস আহারে বেশি স্বচ্ছন্দ। মাংস হিসেবে তাদের ছাগল এবং ভেড়ার মাংসই বেশি পছন্দ। রাজবংশীদের পূর্বপুরুষ কোচ আদিবাসীরা পাখির মাংস আস্বাদনে অভ্যস্থ হলেও, সামাজিক উত্তরণের অভিপ্রায়ে সংস্কৃতায়ন পদ্ধতি অবলম্বন করার জন্য রাজবংশীরা পাখির মাংস খাওয়াতে নিরুৎসাহ দেখায়। 

আরও পড়ুন: উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনজাতি সত্যিই কি রাজবংশীয়?

রাজবংশী জনজাতির মধ্যে ঘোড়দেউ পূজায় শূকর এবং লক্ষ্মী পূজায় হাঁস বলি দেওয়ার রীতি ছিল। যে এখনও কিছুটা প্রচলিত রয়েছে। হাঁস ও মুরগির ডিম খাওয়ার প্রচলনও রয়েছে তাদের মধ্যে। সময় বিশেষে তাদের হাঁস এবং মাছও খেতেও দেখা যায় তবে খুব সীমিত ক্ষেত্রে। বহুবর্ষজীবী না হওয়ায় প্রাকৃতিক কারণেই উত্তরবঙ্গের নদীগুলো বড় জাতের বিভিন্ন প্রকারের ও বড় জাতের মাছ ধারণ করতে পারে না। যদিও, নাম্নী অসম অঞ্চলে, ব্রহ্মপুত্রের মতো বড় নদ ও অন্যান্য নদীগুলি বিভিন্ন ধরণের মাছ ধারণ করে যা সেখানে বসবাসকারী কোচ রাজবংশীদের খাদ্যাভ্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠেছে।

একটি সাধারণ কোচ রাজবংশী বাড়ির বাড়ির নকশা অপরিহার্যভাবে আয়তক্ষেত্রাকার হবে এবং বাড়ির মাঝখানে একটি খোলা জায়গা থাকবে। বেশিরভাগ বন্য প্রাণী এবং শক্তিশালী বাতাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষার জন্য বাড়ির এরকম নকশা করা হয়। প্রতিটি কোচ-রাজবংশী বাড়িতে প্রবেশদ্বারে মনসার ঠাকুরঘর বা কালী ঠাকুর থাকা আবশ্যক। রাজবংশী বাড়িতে উত্তর দিকে সাধারণত  সুপারি এবং ফলের বাগান থাকে, পশ্চিমে বাঁশের বাগান থাকে, পূর্ব এবং দক্ষিণ দিক সাধারণত খোলা রাখা হয় যাতে রোদ এবং বাতাস ঘরে প্রবেশ করতে পারে। যদিও জমিদার স্থানীয় রাজবংশীদের মধ্যে এইভাবে বসতবাড়ির সামগ্রিক পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়।

কোচ-রাজবংশীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের মধ্যে রয়েছে প্রধানত পাটানি, অগ্রণ, অঙ্গশা, চাদর, লিফান, ফোটা এবং অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী পোশাক। তাদের বাড়িতেই তাদের ঐতিহ্যবাহী তাঁতে বোনা হয়। পুরুষদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হল অঙ্গশা এবং জামা, আর মহিলাদের জন্য হল বুকুনি-পাটানি, ফোটা, অগ্রান, অঙ্গসা, লিফান- চাদর বুকের চারপাশে বাঁধা এক টুকরো কাপড় যা হাঁটু পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। লিফান বা ফোটা একটি মোড়কের মত পরা হয়। কোচ রাজবংশী উপজাতি এখনও তাদের পুরানো জাতিগত পোশাকগুলি সংরক্ষণ করেছে এবং নিয়মিতভাবে তাদের সাধারণ পোশাক হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, কোচ রাজবংশীরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করতে পছন্দ করে যদিও আধুনিক পোশাকগুলি ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়।


( লেখিকা নৃতত্ববিদ, মতামত লেখিকার ব্যক্তিগত )

Share:

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn

You may also like

+ There are no comments

Add yours

Recent Articles