Jogendra Nath Mandal: ‘‘কেন পাকিস্তান হিন্দুদের বেঁচে থাকার অধিকার দিল না?’’

পাকিস্তানের প্রথম আইন এবং শ্রমমন্ত্রী ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। ১৯৫০ সালের ৯ অক্টোবর তিনি পদত্যাগ করেন লিয়াকত আলি খানের মন্ত্রিসভা থেকে। তাঁর পদত্যাগপত্র সাতটি পর্বে প্রকাশ করছি আমরা।
jogen
jogen

জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি -পর্ব ৬

পঞ্চম পর্বের পর...

২৬। আমি জনাব নুরুল আমিনকে এই পদের জন্য ৩ জনের নাম সুপারিশ করেছিলাম। এদের মধ্যে একজন ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের এমএ, এলএলবি, অ্যাডভোকেট। তিনি প্রথম ফজলুল হক মন্ত্রিসভার সময়কালে ৪ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলার মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রায় ৬ বছর ধরে কলকাতার কয়লা খনি বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। তিনি নমঃশূদ্রদের ফেডারেশনের সহ-সভাপতি ছিলেন। আমার দ্বিতীয় সুপারিশে ছিলেন একজন বিএ, এলএলবি। তিনিও ৭ বছর যাবৎ আইনসভার সদস্য ছিলেন। আমি জানতে চাই ঠিক কোন কারণে জনাব নুরুল আমিন এই দুজন ভদ্রলোককে বাদ দিয়ে এমন একজনকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিলেন সঙ্গত কারণেই যার নিয়োগের বিরোধিতা আমি করেছিলাম। কোনও প্রতিবাদের মুখোমুখি হবার ভয় ছাড়াই আমি বলতে পারি জনাব নুরুল আমিন বারারিকে দিল্লি চুক্তি অনুসারে মন্ত্রী হিসেবে বেছে নেওয়াই এর চরম প্রমাণ যে পূর্ব বাংলার সরকার এখানকার হিন্দুদের জীবন-জীবিকা, সম্মান ও ধর্ম ঠিক রেখে জীবনধারণের উপযোগী পরিবেশ তৈরির জন্য সম্পাদিত দিল্লি চুক্তিকে কখনওই গুরুত্ব ও আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করেনি।

সরকারি মদতে হিন্দুদের নির্মূল করার চেষ্টা

২৭। আমি এই প্রসঙ্গে আমার পূর্ণ বিশ্বাস রয়েছে যে পূর্ব বাংলা সরকার এই প্রদেশ থেকে হিন্দুদের সম্পূর্ণরূপে উৎখাত করতে চায়। এই বিষয়ে আমি আপনাকে একাধিকবার সাক্ষাতে অনেক কথা বলেছি। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি পশ্চিম পাকিস্তান হিন্দু নিধনে সম্পূর্ণরূপে সক্ষম হয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তানে এই প্রক্রিয়ায় সফলতার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে। ডি এন বারারির নিয়োগ এবং আমার এই বিষয়ে অসম্মতির পরও পাকিস্তান সরকারের প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে তারা কী অর্থে নিজেদের ইসলামিক প্রজাতন্ত্র দাবি করে। পাকিস্তান না হিন্দুদের বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছে না পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়েছে। এখন তারা হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের মারতে চায় যাতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক জীবন তাদের দ্বারা আর প্রভাবিত না হতে পারে।

যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীর বিষয়টিকে এড়িয়ে চলা

২৮। আমি বুঝতে পারি না নির্বাচকমণ্ডলীতে এই বিষয়ে কেন এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। সংখ্যালঘু সাব-কমিটি তৈরির পর ৩ বছর পার হয়ে গেছে। তিনবার মিটিংও হয়ে গিয়েছে। গত ডিসেম্বরে কমিটির সভায় যৌথ বা পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর ব্যাপারে কথা উঠলে পাকিস্তানের সকল স্বীকৃত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিগণ পশ্চাৎপদ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর জন্য সংরক্ষিত আসন রেখে যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীর স্বপক্ষে মত দেন। আমরা নমঃশূদ্রদের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা রেখে যৌথ নির্বাচকমণ্ডলীর দাবি জানাই। গত অগাস্টের আরেক সভাতেও এই ব্যাপারে কথা উঠে। কিন্তু এর উপর কোনওরূপ আলোচনা ছাড়াই সভা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে পাকিস্তানী শাসকদের কালহরণ নীতির পিছনে কোন উদ্দেশ্য কাজ করছে তা বুঝতে কারোরই অসুবিধা হবার কথা নয়।

হিন্দুদের দুঃসহ ভবিষ্যৎ

২৯। এখন বলি দিল্লি চুক্তির ফলে পূর্ব বাংলার হিন্দুদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমি বলতে পারি এখন হিন্দুদের অবস্থা শুধু হতাশাজনক নয় বরং সম্পূর্ণ আশাহীন এবং ভবিষ্যৎ অন্ধাকার অমনিশায় আচ্ছন্ন। পূর্ব বাংলার হিন্দুদের ভিতর আস্থা ফিরিয়ে আনতে কিছুই করা হচ্ছে না। চুক্তিটি মুসলিম লিগ কাগজের ভিতরই সীমাবদ্ধ রেখেছে। বিপুল সংখ্যক হিন্দু শরণার্থী বিশেষ করে নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এলেও এটা প্রমাণ করে না যে হিন্দুদের আস্থা ফিরে এসেছে। বরং এটা প্রমাণিত হয় পশ্চিমবাংলা বা ভারতের ভিতর তাদের পুনর্বাসনের কোনও সুযোগ নেই। উদ্বাস্তু জীবনের বেদনাই তাদের মাতৃভূমিতে ফিরতে বাধ্য করেছে।
পাশাপাশি অনেকেই ফিরে আসছে তাদের অস্থাবর সম্পত্তি সঙ্গে নিয়ে যেতে এবং স্থাবর সম্পত্তির একটা গতি করতে। পূর্ব বাংলায় অতি সাম্প্রতিককালে কোনও বড় রকমের সাম্প্রদায়িক হিংসা ঘটেনি, কিন্তু এর কৃতিত্ব দিল্লি চুক্তিকে দিলে তা ভুল হবে। কোনও চুক্তি বা আপস ছাড়াই এটা একসময় বন্ধ হত, সহজভাবে বলতে গেলে এটা এভাবে চলতে থাকা ছিল অসম্ভব।

৩০। স্বীকার করতেই হবে দিল্লি চুক্তি সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। এই চুক্তির ভিতর ছিল কিছু শর্ত যাতে ভারত এবং পাকিস্তানের ভিতর বিবদমান সমস্যাগুলো সমাধান করা যায়। কিন্তু চুক্তির ছয় মাস পরেও কিছুই হয়নি। অন্যদিকে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে দেশে এবং বিদেশে অপপ্রচার চালিয়েই যাচ্ছে পুরোদমে। মুসলিম লিগ দ্বারা সারা পাকিস্তান জুড়ে কাশ্মীর দিবস পালন করা এর একটি উদাহরণ। পাকিস্তান শাসিত পাঞ্জাবের গভর্নরের সাম্প্রতিক বক্তব্যে তিনি উল্লেখ করেছেন পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনী দরকার ভারতের মুসলিমদের রক্ষায়, পাকিস্তানের আসল চেহারা দেখিয়ে দিয়েছে। এই ধরনের বক্তব্য দুইদেশের ভিতর শুধু উত্তেজনাই বাড়াবে।

(ক্রমশ.....)

 

জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি -পর্ব ৫

জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি -পর্ব ৪

জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি -পর্ব ৩

জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি - পর্ব ২

জিন্নার হিন্দু মন্ত্রীর পাঁচালি - পর্ব ১

 

দেশের খবর, দশের খবর, সব খবর, সবার আগে পেতে ফলো করুন আমাদের Facebook এবং Twitter পেজ।

 



Share:

Facebook
Twitter
WhatsApp
LinkedIn

You may also like

+ There are no comments

Add yours

Recent Articles