মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: ভারতীয় নৌসেনায় (Indian Navy) ‘কমিশন্ড’ করা হল দেশে তৈরি এখনও পর্যন্ত সর্ববৃহৎ তথা প্রথম বিমানবাহী রণতরী ‘আইএনএস বিক্রান্ত’ (INS Vikrant)। শুক্রবার, কোচিতে এক অনুষ্ঠানে এই বিশাল জাহাজকে নৌসেনায় অন্তর্ভুক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Modi)। এই প্রেক্ষিতে, প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের আত্মনির্ভরতার প্রতীরক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে বিক্রান্ত।
আসুন জেনে নেওয়া যাক বিমানবাহী রণতরী ঠিক কী?
একটি এয়ারক্রাফ্ট ক্যারিয়ার বা বিমানবাহী রণতরী (Aircraft Carrier) হল একটি বিশাল জাহাজ যা যুদ্ধবিমান বহন করতে সক্ষম। এতে একটি দীর্ঘ, সমতল পৃষ্ঠ থাকে যেখান থেকে বিমানগুলি ওঠানামা করতে পারে। এই রণতরীগুলো এতটাই বড় যেহেতু এখান থেকে যুদ্ধবিমান ওঠানামা করতে পারে, তাই এদের ‘ফ্লোটিং এয়ারবেস’ বা ভাসমান বিমানঘাঁটি বলে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। বিমানবাহী রণতরীতে যে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ফ্লাইট ডেক থাকে, সেখান থেকে যুদ্ধবিমান টেক-অফ, ল্যান্ডিং ও রিকভারি করতে পারে।
বিমানবাহী রণতরীগুলি যুদ্ধ এবং শান্তির সময়ে একটি নৌবহরের ‘কমান্ড এবং কন্ট্রোল’ কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে। বিমানবাহী রণতরী হল যে কোনও নৌবাহিনীর কাছে ‘কোহিনূর’-এর সমতুল্য। কারণ, ঘাঁটি বা দেশের সীমা থেকে দীর্ঘ দূরত্বে সমুদ্রে বায়ুশক্তি প্রদান করার ক্ষমতা একমাত্র রয়েছে এই বিশেষ জাহাজের। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই একে রক্ষার জন্য সর্বদা থাকে অন্য জাহাজ। কোনও সময়ই বিমানবাহী রণতরী একলা থাকে না। প্রত্যেক বিমানবাহী রণতরীক ঘিরে তৈরি হয় একটি ক্যারিয়ার ব্যাটল গ্রুপ।
প্রত্যেক ব্যাটল গ্রুপের মাথায় থাকে একটি করে বিমানবাহী রণতরী। এছাড়া গ্রুপের বাকি সদস্যদের মধ্যে থাকে ডেস্ট্রয়ার, ফ্রিগেট, সাবমেরিন, ট্যাঙ্কার এবং আকাশে চক্কর কাটতে থাকা বিশেষ নজরদারি বিমান। এদের প্রত্যেকের কাজ হল বিমানবাহী রণতরীকে চারদিকে থেকে এসকর্ট বা পাহারা দেওয়া, যাতে কোনওভাবে এই এয়ারক্রাফ্ট ক্যারিয়ারের কোনও ক্ষতি না হয়। এর থেকেই অনুমেয়, একটি নৌসেনার কাছে তাদের বিমানবাহী রণতরী কতটা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
আরও পড়ুন: এক ভাসমান দুর্গ যার নাম ‘আইএনএস বিক্রান্ত’
ভারতে বর্তমানে একটিই মাত্র অপারেশনাল বিমানবাহী রণতরী রয়েছে— আইএনএস বিক্রমাদিত্য। রুশ নির্মিত এই যুদ্ধজাহাজও আবার বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আইএনএস কারোয়ার ঘাঁটিতে বসে রয়েছে। জলে নামতে অন্ততপক্ষে জানুয়ারি। অন্যদিকে, চিনের বর্তমানে দুটি বিমানবাহী রণতরী রয়েছে। তৃতীয়টির উদ্বোধন হয়েছে সম্প্রতি। ফলে, ভারতীয় মহাসাগরে, চিনের মোকাবিলা করতে নতুন বিমানবাহী রণতরী থাকা ভারতের কাছে কৌশলগত ও সামরিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিস্থিতিতে আইএনএস বিক্রান্ত-এর অন্তর্ভুক্তি অনেকটাই আত্মবিশ্বাস জোগাবে।
আরও পড়ুন: ‘বিক্রান্ত’ নামের কী মাহাত্ম্য? নৌসেনায় তাৎপর্যই বা কী? ফিরে দেখা ইতিহাস
আইএনএস বিক্রান্ত অনেক দিক থেকেই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, এটিই হল ভারতে তৈরি প্রথম রণতরী। এই জাহাজের ৭৬ শতাংশ দেশে তৈরি। দেশের ১৮টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত এলাকায় তৈরি হয়েছে এর যন্ত্রাংশ। এটা জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। এর ফলে, ভারতের সামরিক সক্ষমতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেল। এই নির্মাণ ভারতকে বিশ্বের হাতেগোনা রাষ্ট্রের একটি এলিট তালিকায় বসিয়ে দিল। বিশ্বের হাতে গোনা দেশ রয়েছে, যারা বিমাণবাহী রণতরী ব্যবহার করে। তৈরি করাটা অনেক দূরের ব্যাপার। সেই দিক দিয়ে, ভারত নিজের বিমানবাহী রণতরী নির্মাণ করে আত্মনির্ভরতা ও সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে।
বিমানবাহী রণতরী থাকার তাৎপর্য
বর্তমানে, বিশ্বের প্রধান সামরিক শক্তিধর দেশগুলির কাছে বিমানবাহী রণতরী রয়েছে। প্রায় প্রত্যেকটি দেশ— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে চিন, রাশিয়া, ফ্রান্স ও ব্রিটেন— সকলেই নিজ দেশে বিমানবাহী রণতরী (Indigenous Aircraft Carrier) নির্মাণ করে থাকে। সেই তালিকায় সংযোজিত হল ভারত। বলা বাহুল্য, এক এলিট গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হল ভারতীয় নৌবাহিনী। যে কোনও দেশের সামরিক বাহিনীতে বিশেষ করে নৌসেনায় বিমানবাহী রণতরীর তাৎপর্য অপরিসীম। এটি সেই সকল দেশের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ যাদের বিস্তৃত জলসীমা রয়েছে। যেমন ভারত। আফ্রিকার পূর্ব সীমান্ত থেকে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর— সমগ্র ভারত মহাসাগর অঞ্চলে নিজেদের নৌ-শক্তি ও জলসীমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিমানবাহী রণতরী অপরিহার্য। এক কথায় দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার্থে আস্তিনে বিমানবাহী রণতরী থাকা ও না থাকার মধ্যে ফারাকটা বিস্তর। এধরণের আস্ত বিমানঘাঁটি মাঝ-সমুদ্রে ভেসে বেড়ালে, শক্তিশালী শত্রুও যে কোনও আগ্রাসনের আগে দশবার ভাববে। আর ভারতের জলসীমা বা সমুদ্র অঞ্চল এতটাই বিস্তৃত যে, তৃতীয় (দ্বিতীয় দেশীয়) বিমানবাহী রণতরীর নির্মাণ নিয়ে মোদি সরকারের শীর্ষস্তরে ইতিমধ্যেই জোর আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে।
+ There are no comments
Add yours