মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: শুক্রবার রথযাত্রা (Rath Yatra 2022)। ভারতের বিভিন্ন স্থান-সহ ডাবলিন, নিউ ইয়র্ক, টরেন্টো ও লাওসে-ও রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়। তবে রথযাত্রার সবচেয়ে বড় উৎসবটি হয় অবশ্যই জগন্নাথ-ধাম (Jagannath Dham), ওড়িশার পুরীতে (Puri Odisha)। পুরীর রথ কিন্তু প্রতি বছর নতুন করে নির্মাণ করা হয়। অপরিবর্তিত থাকে রথের উচ্চতা-সহ অন্যান্য বৈশিষ্ট্য। কারণ চাকার সংখ্যা থেকে নির্মাণে ব্যবহৃত কাঠের সংখ্যা, সবই বিশেষ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
পুরীর রথটি সম্পূর্ণই কাঠের তৈরি। তবে যে সে কাঠ হলে চলবে না। ফাঁসি ও ধাউসা গাছের কাঠ দিয়েই নির্মাণ করা হয় এই রথ। রথের নির্মাণ অক্ষয় তৃতীয়া (Akshay Tritiya) থেকে শুরু হয়। সেই কাঠ সংগ্রহ করা হয় মাঘ মাসের বসন্ত পঞ্চমী (Vasant Panchami) তিথিতে। আর সেই কাঠগুলি নির্দিষ্ট পরিমাণে কাটা শুরু হয় রামনবমী (Ram Navami) তিথি থেকে। রথগুলিতে অন্য কোনও ধাতু ব্যবহার করা হয় না। রথের পেরেকও তৈরি হয় কাঠ দিয়ে। ভগবান জগন্নাথ, ভগবান বলভদ্র এবং দেবী সুভদ্রা এই তিনটি দেবতাকে উৎসর্গীকৃত তিনটি রথ সম্পূর্ণ করতে প্রায় দুই মাস সময় লাগে।
আরও পড়ুন: পুরীর রথযাত্রার তিন রথের আলাদা মাহাত্ম্য আছে, জানেন কি?
পুরাণে কথিত আছে, প্রতি বছর মহানদীর (Mahanadi) স্রোতে ভেসে আসে রথ নির্মাণের প্রয়োজনীয় কাঠ। পুরীর কাছে এক স্থানে সেই কাঠগুলি মহানদী থেকে তুলে ট্রাকে করে নিয়ে আসা হয়। এরপর দসাপাল্লা নামে একটি স্থান থেকে একদল বিশেষ কাঠমিস্ত্রি এসে রথ নির্মাণ করে। দসাপাল্লা আগে একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। এখানকার কাঠের মিস্ত্রিরা অত্যন্ত দক্ষ। রথযাত্রার শুরুর সময় থেকেই দসাপাল্লার কাঠমিস্ত্রিরাই রথ নির্মাণ করেন। রথের ছাউনি তৈরি হয় কাপড় দিয়ে। এতে ১,২০০ মিটার কাপড় লাগে।
পুরীর রথের মোট ৪২টি চাকা দেখা যায়। জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা - প্রত্যেকের আলাদা আলাদা রথ রয়েছে। জগন্নাথের রথের নাম নন্দীঘোষ/গরুড়ধ্বজ/কপিধ্বজ৷ এই রথে রয়েছে ১৬টি চাকা ৷ এই ১৬টি চাকার একেকটি দশ ইন্দ্রিয় আর ছয় রিপুর প্রতিনিধিত্ব করে। বলরামের রথের নাম তালধ্বজ বা হলধ্বজ ৷ এর চাকার সংখ্যা ১৪৷ এই ১৪টি চাকায় ধরা থাকে ১৪টি ভুবনের কথা। আর সুভদ্রার রথ, দর্পদলন/দেবদলন/পদ্মধ্বজ। এই রথের ১২টি চাকা বোঝায় ১২ মাসই ভজনের সময়।
আরও পড়ুন: পুরীর মন্দির ঘিরে রয়েছে এই অলৌকিক গল্পগুলি, জানতেন কি?
রথটি শুধুমাত্র কাঠের তৈরি বলে চলার সময় কাঠের ঘড়-ঘড় শব্দ হয়। কেউ কেউ এই শব্দে বিরক্ত বোধ করলেও এই শব্দ কিন্তু রথযাত্রার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আসলে হিন্দু ধর্মে শব্দের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। ঘণ্টাধ্বনী থেকে মন্ত্রোচ্চারণ সব শব্দই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। বেদে বলা হয়েছে 'শব্দই ব্রহ্ম'। কাজজেই পুরীর রথের কাঠের চাকার ঘড়ঘড়ে শব্দেরও গুরুত্ব রয়েছে, একে বলা হয় বেদ। অর্থাত এই শব্দ বেদের মতোই সত্য।
রথ থেকে দেবতার বিগ্রহ সবই কাঠ-নির্মিত হলেও পুরীর জগন্নাথের রথযাত্রায় কিন্তু সোনাদানার অভাব নেই। জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার যাবতীয় অলঙ্কারই থাকে সোনার। মোট ২০৮ কিলোগ্রাম ওজনের সোনার অলঙ্কারে সেজে মাসির বাড়ি রওনা হন তিন ভাই-বোন। আবার রথযাত্রার সূচনাটিও সোনায় মোড়া। পুরীর মহারাজা সোনার ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা ঝাড় দিয়ে রথযাত্রার সূচনা করেন। ঝাড়ু দেওয়ার পরই পুরীর মন্দির থেকে বাইরে আসেন জগন্নাথ। পুরির রথযাত্রার এইসব উপাচার পোড়া পিঠা নামে পরিচিত।
আরও পড়ুন: কীভাবে শুরু হয়েছিল পুরীর জগন্নাথ রথযাত্রা? জেনে নিন
রথের দিন প্রতিটি রথকে পঞ্চাশ গজ দড়িতে বেঁধে আলাদা আলাদা ভাবে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় গুণ্ডিচাবাড়ি। রথের রশি টানার জন্য ভক্তদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। কারণ এই কাজে সবচেয়ে পুন্য অর্জন করা যায় বলে ভক্তরা বিশ্বাস করেন। বাংলায় রজ্জুতে সর্পভ্রমের প্রবাদ আছে। প্রতিবেশী দেশ ওড়িশার পুরীর এই রথের দড়ি কিন্তু সত্যি সত্যিই একটি সাপের কথা বলে। কথিত আছে বাসুকি নাগই নাকি রথের দড়ি হিসেবে নিজেকে নিবেদন করে। সেজন্য ভক্তরা বিশ্বাস করেন, রথের দড়ি ধরলে বাসুকিনাগের কৃপা লাভ হয়৷
তবে যাঁরা দড়ি ধরার সুযোগ পান না, তাঁদেরও পুন্য অর্জনের উপায় আছে। পুরীর রথ চলার সময়, রাস্তায় যে চাকার দাগ পরে, তাও পবিত্র হিসেবে গন্য করা হয়। তিনটি রথের তিনটি দাগ— গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী - এই তিন পবিত্র নদীর সমান বলে মনে করা হয়। বিশ্বাস, যাঁরা রথের দড়ি ধরার সুযোগ পান না, তাঁরা যদি চাকার এই তিনটি দাগের ধুলি গ্রহন করেন, তাহলে গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতীতে অবগাহনের (ডুব দিয়ে স্নান করার ন্যায়) ফল লাভ করেন৷
আরও পড়ুন: প্রতিবছর রথযাত্রার আগে জ্বর আসে জগন্নাথদেবের, কেমন করা হয় চিকিৎসা?
+ There are no comments
Add yours