মাধ্যম নিউজ ডেস্ক: রাজ্যের বর্তমান শাসক শিবিরের রোষের মুখে বারবার পড়তে হয়েছে বিরোধী দলগুলিকে। এটা নতুন কিছু নয়। বিরোধিতা করায় অনেক শিল্পী থেকে বুদ্ধিজীবীকেও হুমকি-হুঁশিয়ারি সহ্য করতে হয়েছে। এমনকী, অপ্রিয় সত্য খবর লেখার জন্য রাজ্য সরকারের শ্যেনদৃষ্টির সামনা-সামনি হতে হয়েছে ও হতে হচ্ছে সংবাদমাধ্যমকেও।
কিন্তু, ১৩ এপ্রিল এই সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল তৃণমূলের 'দাদাগিরি'। এবার রাজ্যের শাসক শিবিরের রক্তচক্ষুর সামনে খোদ বিচারপতি! বলা ভাল, বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। যা ঘিরে বেনজির দৃষ্টান্তের সাক্ষী থাকল কলকাতা হাইকোর্ট।
কিন্তু, কেন হঠাৎ এই বিচারপতিকে টার্গেট করা শুরু করল তৃণমূল? বিচারপতি আবার কী 'দোষ' করলেন? আসলে এই যে রাজ্যে একের পর এক মামলা বা ঘটনার তদন্তভার পুলিশের হাত থেকে সরিয়ে তুলে দেওয়া হচ্ছে সিবিআইয়ের হাতে, এটাই ঘটনার মূল কারণ।
ভাদু শেখ থেকে বহটুই, তপন কান্দু থেকে হাঁসখালি --- গত দশ দিনের মধ্য়ে রাজ্য পুলিশের অধীনে থাকা পাঁচটি মামলা সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিয়েছে উচ্চ আদালত। আর সবকটিই নির্দেশই দিয়েছে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। বলা বাহুল্য, এতে রাজ্য সরকারের মুখ যারপরনাই পুড়েছে। হাইকোর্টের এই নির্দেশে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, রাজ্য প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলার ওপর আদালতের একেবারেই ভরসা নেই।
এই সব মামলার নির্দেশের ফলে, তৃণমূল যে চরম অস্বস্তিতে পড়েছিল, তা প্রমাণিত। এর ওপর তাতে ঘৃতাহুতি পড়ে এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় রাজ্যের হেভিওয়েট মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্য়ায়ের উদ্দেশ্যে দেওয়া অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের দৃষ্টান্ত-স্থাপনকারী নির্দেশ।
কিছুদিন আগে, গরু ও কয়লা পাচারকাণ্ডের তদন্তের স্বার্থে তৃণমূলের দাপুটে নেতা তথা বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে ডেকে পাঠিয়েছিল সিবিআই। হাজিরার দিন, সিবিআই দফতর না পৌঁছে অনুব্রত সটান গিয়ে ভর্তি হয়ে যান এসএসকেএম হাসপাতালে।
এমন ঘটনা যে প্রথম তেমনটা নয়। অতীতেও দেখা গিয়েছে সিবিআই তলব করতেই, তৃণমূলের একাধিক নেতা অসুস্থ হয়ে গিয়ে এই এসএসকেএমের দ্বারস্থ হয়েছেন। অনুব্রতর ক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি। আদালত তা নজরে রেখেছিল।
এদিকে, স্কুল সার্ভিস কমিশনের গ্রুপ-সি ও গ্রুপ-ডি এবং নবম-দশম শ্রেণিতে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। সেই প্রেক্ষিতে পার্থকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানোর জন্য উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। সেই প্রক্ষিতেই অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বেঞ্চ জানায়, হাজিরা দিতে হবে পার্থকে। এমনকী, তিনি এসএসকেএমে ভর্তিও হতে পারবেন না বলে নির্দেশ দেন বিচারপতি।
এই নির্দেশের ফলেই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তৃণমূলের রোষে পড়েন। যার নিটফল হল হাইকোর্টে তৃণমূলপন্থী আইনজীবীদের বিক্ষোভ-প্রদর্শন। যাঁদের মূল দাবি, বিচারপতি পরপর একপেশে নির্দেশ দিচ্ছেন। সেই জন্য অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্য়ায়ের বেঞ্চ বয়কটের দাবি তোলেন তাঁরা।
তবে, রোষের মুখেও অবিচল বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সাফ জানিয়ে দেন, দুর্নীতি দেখলে চুপ থাকতে পারবেন না। এজলাসে বিক্ষোভকারীদের তিনি কড়া ভাষায় ভর্ৎসনা করেন। বিক্ষোভকারী তৃণমূলপন্থী আইনজীবীদের উদ্দেশ্যে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, "আপনার হয়তো রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকতে পারে। কিন্তু দুর্নীতি দেখলে আদালত চুপ থাকবে না। যে দুর্নীতি করবে, সে যে রাজনৈতিক দলের হোক না কেন ছেড়ে দেওয়া হবে না।"
প্রবল বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েও নিজের সিদ্ধান্তে অটল এই দৃঢ়চেতা বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, "আমার মাথায় বন্দুক ধরতে পারেন। মরতে রাজি। কিন্তু দুর্নীতি দেখে চুপ থাকবে না আদালত। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চলবে!"
সাম্প্রতিককালে, রাজ্যে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনাপ্রবাহে তৃণমূলের পায়ের তলার জমি ক্রমশ সরে যাচ্ছে। তা রাজ্যের শাসক দল ভালই টের পাচ্ছে। ফলস্বরূপ, দলের মধ্য়েও শুরু হয়েছে কোন্দল, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। এমনকী, খোদ দলের সুপ্রিমো তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর গলাতে শোনা গিয়েছে একাধিক হঠকারী ও বিতর্কিত মন্তব্য।
তার ওপর আদালতের পরের পর নির্দেশে প্রবল সমালোচনার মুখে রাজ্যের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। অতএব, এসব বিষয়টিকে মাথায় রেখেই তৃণমূলের লক্ষ্য এখন সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে কব্জা করা। সেটা না করতে পেরে নৈরাশ্যের চরম উদাহরণ তুলে ধরছে রাজ্যের শাসক দল।
+ There are no comments
Add yours